ছামির মাহমুদ, সিলেট: ১৩ মিনিট সময় ধরে নিজের ওপর ভয়াবহ হামলার বর্ণনা দিয়ে আদালতের কাছে ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করলেন খাদিজা আক্তার নার্গিস। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে খাদিজা হত্যাচেষ্টা মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আগামী ১ মার্চ তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।
এসময় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামি বদরুল আলম বলতে থাকেন, ‘আমার ফাঁসি হোক, তারপরও খাদিজা তুমি ভালো থেকো। তোমার ভালো হোক।’ পরে বিচারক বদরুলকে কোনো কথা বলতে নিষেধ করেন।
রোববার দুপুরে সিলেট মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতের বিচারক সাইফুজ্জামান হিরোর কাছে ঘটনার বর্ণনা দেন খাদিজা। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে দণ্ডবিধির ৩৪২ ধারায় আসামি শনাক্ত করেন আদালত।
নিজের ওপর ভয়াবহ হামলার বর্ণনা দিয়ে আদালতে খাদিজা আক্তার নার্গিস বলেন, ‘৩ অক্টোবর বিকেল ৫টায় এমসি কলেজে পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে আমি আমার বান্ধবী রূপমার সঙ্গে হাঁটার সময় হঠাৎ বদরুল গরু কাটার চাপাতি হাতে নিয়ে আমার হাত ধরে জোরপূর্বক টেনে কলেজের পুকুরের পূর্ব পাড়ে নিয়ে যায়। বদরুল আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চাপাতি দিয়ে আমার মাথায় কোপ মারলে প্রথমে বাম হাত ও পরে দুই হাত দিয়ে চারটি কোপ ঠেকাই। বদরুল আমার মাথায় অসংখ্যবার কোপ মারলে আমার বাম কানের উপরের অংশ কেটে যায় এবং নিচের অংশে আঘাত লাগে। এরপর বাম পায়ের হাঁটুতে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।’
সাক্ষ্যে খাদিজা আরও বলেন, আমার শরীরের যে যে স্থানে আসামি আঘাত করেছে, সেসব জায়গায় দাগ আছে।
এ সময় তিনি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামিকে শনাক্ত করে বলেন, আমি আসামি বদরুলের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। সে আমাকে সারা জীবনের জন্য প্রতিবন্ধী করেছে। আমি এর বিচার চাই।
পরে আসামি পক্ষের আইনজীবী সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী খাদিজাকে জেরা করেন। জেরায় খাদিজা বলেন, আসামি ৫-৬ বছর আগে আমাদের বাড়িতে আমার ছোট ভাইকে পড়াত।
আইনজীবী এসময় বদরুলের সঙ্গে খাদিজার প্রেমের সম্পর্ক ছিল কিনা জানতে চাইলে জবাবে খাদিজা বলেন, এ কথা সত্য নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে খাদিজা বলেন, আসামি আমাকে পরীক্ষার দিন পানির বোতল দিয়েছিল, আমি নেইনি। আমার ওই পরীক্ষা ২৯ সেপ্টেম্বর ছিল। ৩ অক্টোবর ঘটনার দিন পরীক্ষার আগে আমার সঙ্গে আসামির দেখা হয় একথাও সত্য নয়। আমি আসামির সঙ্গে স্বেচ্ছায় ঘটনাস্থলে যাইনি।
এসময় আসামি পক্ষের আইনজীবী সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী খাদিজাকে আসামির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এবং মেমোরিকার্ড নেয়ার জন্য ওইদিন আসামির সঙ্গে আপনার কটাক্ষ হয় এমন প্রশ্নের জবাবেও খাদিজা বলেন, এসব কথা সত্য নয়।
বদরুলের আইনজীবী বলেন, আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করেছেন বদরুল। খাদিজার ওপর হামলার ঘটনার সময় বদরুল স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না। তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন। এসব কারণে আদালত বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় নিয়ে তার মক্কেলকে খালাস দেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
খাদিজার আইনজীবী আ ক ম শিবলী বলেন, আদালতে দাঁড়িয়ে খাদিজা তার ওপর হামলাকারী বদরুলের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন। আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণে বদরুলকে অপরাধী হিসেবে আদালতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, বদরুল পূর্বপরিকল্পিতভাবে খাদিজার ওপর হামলা করেছিল। এখন সে নেশাগ্রস্ত ছিল বলে ভণিতা করা হচ্ছে। এসব ভণিতা ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত করবে না। আদালতে আবেগের স্থান নেই।
আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি মাহফুজুর রহমান জানান, আজ সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান হিরোর আদালতে খাদিজার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। খাদিজা হত্যাচেষ্টা মামলায় মোট ৩৬ সাক্ষীর মধ্যে এ নিয়ে ৩৪ জনের সাক্ষী নেয়া হলো।
তিনি জানান, আগামী ১ মার্চ আদালত যুক্তিতর্ক শুনানির তারিখ ধার্য করেছেন। ওই দিন আসামি ও বাদী পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি খণ্ডন করে বক্তব্য রাখবেন।
এর আগে খাদিজার ওপর হামলা মামলার আসামি বদরুল আলমকেও রোববার সকাল ১০টায় আদালতে হাজির করা হয়। হামলার ঘটনার ৪ মাস ২২ দিন পর রোববার প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হন বদরুল ও খাদিজা।
এদিকে খাদিজা আজ আদালতে আসছেন এমন খবরে বিপুলসংখ্যক উৎসুক জনতা সিলেটের মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতের সামনে ভিড় করেন। সাক্ষ্য দিয়ে বের হওয়ার সময় উৎসুক লোকজন খাদিজাকে ঘিরে ধরেন।
এসময় নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের তাকে গাড়িতে তুলে দিতে বেশ বেগ পেতে হয়। দুই মিনিটের রাস্তা যেতে ২৫ মিনিট সময় লেগে যায়।
আদালত থেকে বের হওয়ার সময় এক প্রতিক্রিয়ায় খাদিজা আক্তার নার্গিস সাংবাদিকদের বলেন, আমি বদরুলের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আদালতকে বলেছি আমার মতো আর কোনো মেয়ে যেন এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয়। আমার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।
উল্লেখ্য, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সাভার পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) প্রায় তিন মাস চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে নিজ বাড়ি সিলেটের আউশায় ফিরেছেন শাবি ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের চাপাতির আঘাতে গুরুতর আহত কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস।
গত বছরের ৩ অক্টোবর এমসি কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার সময় বদরুল আলমের হামলার শিকার হন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা। গুরুতর আহত অবস্থায় খাদিজাকে প্রথমে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
স্কয়ারে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তার অবস্থার উন্নতি হলে গত ২৮ নভেম্বর খাদিজাকে সিআরপিতে ভর্তি করা হয়।
এদিকে খাদিজাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় বদরুল এখন কারাগারে। বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শাবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। ঘটনার পর তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ।-জাগো নিউজ
২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৭/ এমটিনিউজ২৪ডটকম/এইচএস/কেএস