সিদ্দিক আলম দয়াল, উত্তরাঞ্চল থেকে : চিন্তায় ঘুম আসে না। সারারাত ছলের বাপক নিয়া বান্দের উপর বসি থাকি। ঘুটঘুটা আন্ধার। একদিকে ৩ ছল আর একদিকে গরু। গোটা গাঁয়ের মানুষ বান্দের উপর থাকে। সগলে গরু পাহারা দেয়। নৌকার ভটভটি শব্দ শুনলে চিৎকার দিয়া কয় আগাও বাহে। এভাবেই দুর্ভোগের বর্ণনা দেন গৃহবধূ অনিতা।
গাইবান্ধা শহর থেকে ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার পূর্বদিকে ব্রহ্ম্পুত্র নদ। তীর ঘেঁষে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। জায়গাটার নাম ছিলো রসুলপুর। এখন ভাঙতে ভাঙতে ডেড়া ঠেকেছে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ভাষারপাড়া গ্রামে। গ্রাম বলতে শ’ খানেক পরিবার। বাঁধের দু’পাশে আশ্রয়। ঘরবাড়ি জায়গা জমি সব নদীগর্ভে যাওয়ার পর ভাসতে ভাসতে ভাষারপাড়ায় এসে ঠেকেছে অনিতার সংসার।
বাঁধ থেকে অন্তত ৫ কিলোমিটার দূরে ছিলো অনিতাদের ঘরবাড়ি। সবাই জানতো জেলেপাড়া। অন্তত ৩শ’ জেলে পরিবার একসঙ্গে বাস করতো। নদী-নির্ভর এই পরিবারগুলো জোট বেঁধে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর ঘেঁষে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশেই একটি ঘর অনিতা রানীর। স্বামী নিতাই চন্দ্রের জালে মাছ ধরা পড়লে খাওয়া জোটে। আর মাছ ধরতে না পারলে অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। এ অবস্থায় মেয়ের চিন্তা মাথায়। মেয়ে হলে টাকা জমা করতে হয় নতুবা গরু।
কারণ ভবিষ্যৎ ভাবতে গেলে অনিতাকে বুঝেশুনে পা ফেলতে হয়। স্বামীর প্রতিদিনের আয় রোজগার থেকে অনিতা ৩ বছর আগে ১৬ হাজার টাকায় একটি গরু কিনে পালন শুরু করেন। অনিতার কথা মেয়ে লিপির বয়স এখন ৯ বছর। দেখতে দেখতে দিন পার হবে। সঙ্গে বড় হবে তার মেয়ে লিপি রানী। বিয়ের সময় অনেক টাকা-পয়সার বিষয় তাই এই গরু তার ভরসা। মেয়ে বড় হচ্ছে সঙ্গে বড় হচ্ছে তার গরুটি। প্রতি বছর নদীতে পানি বাড়লেই ঘুমাতে পারে না অনিতা রানী। ঘুম হারাম হয়ে যায়।
বর্ষা ও বন্যার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়ে যায় নৌ ডাকাতি। নৌ ডাকাতরা একযোগে গ্রামে হানা দিয়ে গরু ছাগল ও ধান চালসহ জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। গেলো বছর ডাকাতি হয়েছে তার পাশের গ্রাম সৈয়দপুরে। গবাদি পশু ডাকাতের হাতে তুলে দেয়নি বলে ডাকাতের গুলিতে একজন আহত হয়েছে। সে বছর অনিতা তার দুই সন্তান ও গরুটি নিয়ে চিৎকার দিতে দিতে অন্ধকারে ছুটে পালিয়ে যায় পাশের গ্রামের দিকে।
সে কারণে সে বছর পার করেছে। অনিতার কথা গরু আমার ছেলের মতো। গরু আমার পরিবারের সম্বল। তাই সংসারের পাশাপাশি গরুর যত্ন করতে অবহেলা করেন না। এবার অনিতার ঘরে একবুক পানি উঠেছে। তাই সন্তান ও গরুটি নিয়ে রাস্তায় উঠেছেন। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে এবার রাতে পালাকরে পাহারা দেয় গরুটি। দিনভর জাল দিয়ে মাছ শিকার। তারপর ক্লান্ত শরীর নিতাইয়ের। তাই অনিতাকেই বেশির ভাগ রাত জেগে থাকতে হয়।
স্বামী নিতাই ঘুমিয়ে পড়লে অনিতা হ্যারিকেন আর টর্চের আলোয় নদীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এভাবে গত ৫ রাত ধরে ঘুম নেই। দিনে সংসারের জন্য কাজ। রান্না-বান্না, সন্তানের যত্ন আর গরুর যত্ন নেয়া। রাতে স্বামী-স্ত্রী মিলে গরু পাহারা। বন্যা ও নদী-নির্ভর তার পরিবার হলেও তার ভয় হয় বন্যার সময়।
এ সময় ডাকাতের আতঙ্ক। নদীপাড়ের কোনো মানুষ ঘুমাতে পারে না। জানমাল রক্ষায় অনিতার মতো বসে শুয়ে রাত কাটায় অনেকেই। অনিতার কথা জীবন দেবো তবু গরু দেবো না। তাই গরুর গলার রশি ধরে রাতভর বসি থাকি। এই গরু হামার ভবিষ্যৎ। গরুটা একন বড় হচে দাদা। ডাকাতের নজর পড়লে মোর আর বাঁচার বুদ্ধি নাই। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি