আরিফ হাসান, ঠাকুরগাঁও : ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সীমান্তঘেষা গ্রাম উত্তর পাড়িয়া। এ গ্রামের ভুবেন চন্দ্র সিংহ ও সরলা দেবীর ঘরে জন্ম নেন নিরেন চন্দ্র সিংহ। জন্ম তারিখ সরকারি নথি অনুযায়ী ১৯৮০ সালের ২২ জুন। অথচ সরকারি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
শুধু তাই নয়, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্রও পেয়েছেন। আর সেই পরিচয়ের জোরে প্রতি মাসে পাচ্ছেন ভাতা, চিকিৎসা সুবিধা ও অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে- ১৯৮০ সালে জন্ম নেওয়া একজন মানুষ কিভাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন?
স্থানীয়রা জানান, নিরেন নিজের বয়স বাড়িয়ে সরকারি নথিতে এমনভাবে পরিবর্তন করেছেন যে, জন্ম তারিখ দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আগের সময়ে। তার নিজের বড় বোন শান্তি রাণীর জন্ম ১৯৭৯ সালে।
এতে দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে তার বোন ৯ বছরের বড়। অথচ সরকারি নথিতে আবার নিরেনকেই বড় দেখানো হয়েছে। তার এই অসঙ্গতি ঘিরে এলাকায় চলছে তুমুল আলোচনা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিরেনের মায়ের জন্ম ১৯৩৮ সালে এবং নিরেনের জন্মসাল ১৯৫০। এতে দেখা যাচ্ছে নিরেন তার মায়ের চেয়ে মাত্র ১২ বছরের ছোট।
মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি নেই
নিরেনকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তরই দিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কোন সেক্টরে ছিলেন, কিভাবে যুদ্ধ করেছেন—এসব বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। অথচ সরকারি সুবিধা নিতে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিচ্ছেন।
নিরেন বলেন, ‘আমার সনদ আছে, ভাতা পাই। আর কিছু জানি না।’
একই অভিযোগ আরো দুজনের বিরুদ্ধে
শুধু নিরেন নন, একই উপজেলার দুওসুও ইউনিয়নের মোখলেসুর রহমান চৌধুরী ও আব্দুস সালাম চৌধুরীর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের দাবি, তারা আওয়ামী লীগ নেতাদের যোগসাজশে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে তারা এলাকায় আত্মগোপনে চলে গেছেন। বর্তমানে তাদের খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ
এলাকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বিষয়টি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা কলঙ্কিত করছেন।
সবীর মুক্তিযোদ্ধা দবিরুল ইসলাম, সাবেক কমান্ডার, বালিয়াডাঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বলেন, ‘আমরা জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। অথচ আজ যারা যুদ্ধই করেনি, তারা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা ভোগ করছে। এটা জাতির সাথে প্রতারণা।’
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নইলে স্বাধীনতার চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইসরাত ফারজানা বলেন, ‘যদি কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তালিকা যাচাই-বাছাই চলছে। অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে ভাতা বন্ধ করা হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’-কালের কণ্ঠ