জাকারিয়া পলাশ: ২০০৪ থেকে ২০১৬। মাত্র ১২ বছর। এর মধ্যেই বদলে গেছে অফিনা বেগমের জীবন। অক্লান্ত পরিশ্রম আর সততাই ছিল পুঁজি। শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা হিসাবে পেয়েছেন পুরস্কার। আজ তিনি সমাজের অনুকরণীয় এক সংগ্রামী নারী। গরুর গোবর, খড়কুটা দিয়ে নিজ বাড়িতে জৈবসার তৈরি করে, গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে আজ তিনি সফলতার শীর্ষে। তার জৈবসার এখন রপ্তানি হতে যাচ্ছে বিদেশেও। অফিনার বাড়ি ঠাকুরগাঁও মাদারগঞ্জের বিশ্বাসপুর গ্রামে। ত্রিশ বছর আগে ১৯৮৬ সালে বিয়ে হয়েছিল অফিনার। তার স্বামী খলিলুর রহমান চাকরি করতেন সেনাবাহিনীতে। স্বামী ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম। সংসারের পাশাপাশি খলিলের কাঁধে ভাই বোনের দায়িত্বও। সব চালাতে গিয়ে তিনি হয়ে পড়েন নিঃস্ব। অবসর নেন ১৯৯৪ সালে। গ্রামে মুদি দোকান দিয়ে দিন চালাতে শুরু করেন। তাতেও লাভ হয়নি তেমন একটা। বিকল্প আয়ের সংস্থানই তখন অফিনা বেগমের ভাবনা।
তিনি জানান, ছোটবেলায় স্কুলে পড়তেন। তখন দেখতেন কৃষি অফিসের লোকেরা গ্রামে এসে কৃষকদের বলছে জৈবসারের উপকারিতা। ধারণাটা অফিনার মাথায় ছিল। তিনি ছুটে গেলেন কৃষি বিভাগে। রপ্ত করে নিলেন জৈবসার উৎপাদনের প্রক্রিয়া। বাড়িতে গোবর ও খড়কুটা মিলিয়ে সীমীত পরিসরে শুরু করেন সার তৈরি। সারের মান ভালো হওয়ায় গ্রামের অন্যরাও আসতে থাকে তার কাছে সার নেয়ার জন্য। প্রশংসা পেলেন কৃষকদের। সাহস বাড়ল। কিন্তু, পুঁজির অভাবে প্রসারিত করতে পারছিলেন না ব্যবসা। এমন সময়, তার স্বামীর পেনশন থেকে পাওয়া ৩৫ হাজার টাকা হাতে এল। সেই টাকায় ভাড়া নিলেন বিসিকের একটি কক্ষ। গ্রামে গ্রামে কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। অষ্টম শ্রেণি পাস করা কৃষকের সন্তান অফিনা তাদের বোঝাতেন জৈবসারের গুরুত্ব। এরই মধ্যে আরও ২০ হাজার টাকা ঋণ পান ইকো-সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট (ইএসডিও) নামে এক সংস্থা থেকে। কী কী উপাদান দিয়ে বানান এই জৈবসার?
অফিনা বলেন, গোবর, হাড়ের গুঁড়া, ঝিনুক-শামুক আর শুঁটকির গুঁড়া, গরুর প্রস্রাব সবকিছু মিশিয়ে একটা বন্ধ হাউজের মধ্যে রাখি। পরে সেটা জৈবসার হয়ে যায়। এতে নেই কোনো কেমিক্যল। ‘রাকিব এগ্রো জৈবসার’। প্যাকেটজাত করে বিক্রি করি। এলাকায় যাদের গরু আছে তাদের কাছ থেকে ড্রেন করে গরুর প্রস্রাব ও গোবর আনা হয়। উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় জনপ্রিয় এই জৈবসার। ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারি, রংপুর, দিনাজপুর। চারটি মোটরসাইকেলে করে এখন চারজন প্রচারক ছুটে বেড়ান সারের মার্কেটিং করার জন্য। বিভিন্ন জেলায় সার সরবরাহ করা হয় পিকআপ ভ্যানে করে। অফিনা বেগমের রয়েছে দুটি পিকআপ ভ্যান। বর্তমানে তার নিজস্ব মূলধন রয়েছে প্রায় ৩২ লাখ টাকা। ক্রয় করা হয়েছে সাড়ে চারলাখ টাকায় তিন শতক জমি। বর্তমানে তিনি কর্মসংস্থান করছেন ৩৫ জন নারী (২২জন স্থায়ী ও ১৩ জন অস্থায়ী) এবং ১৮ জন পুরুষকে (স্থায়ী ৮, অস্থায়ী ১০ জন)। তিনি প্রতিদিন উৎপাদন করেন প্রায় পাঁচ হাজার কেজি জৈবসার। মাসে প্রায় ৮-১০ টন সার উৎপাদন করেন।
অফিনা বেগম জানান, বিদেশ থেকে কয়েকজন লোক ইতিমধ্যে তার সার দেখতে এসেছিলেন। খুব দ্রুতই এই সার বিদেশে রপ্তানি হতে যাচ্ছে। অফিনার এই সাফল্যের স্বীকৃতি মিলেছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকে। সিটি ব্যাংক এন.এ ও সাজেদা ফাউন্ডেশন তাকে পুরস্কৃত করেছে শ্রেষ্ঠ নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসাবে। গত ৩রা মে ২০১৬ ঢাকায় ১১তম ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে অফিনা বেগমকে দেয়া হয় সাড়ে তিন লাখ টাকা। সাজেদা ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর দিলিপ মজুমদার জানান, সিটি ব্যাংক এন.এ গত ১০ বছর ধরেই ‘সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ পুরস্কার’ দিয়ে আসছে।
এবার এই পুরস্কারের জন্য বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে বাছাই প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা করেছে সাজেদা ফাউন্ডেশন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, রাশেদা কে চৌধুরী, রোকেয়া এ. রহমান, সাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দীন আহমেদ ও পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ করিম সম্মিলিতভাবে যাচাই-বাছাই করে ক্ষুদ্র-উদ্যোক্তা ব্যক্তি ও সংগঠনকে বাছাই করেন। অফিনা বেগম তিন সন্তানের জননী। বড় মেয়েকে প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াচ্ছেন ঢাকায়, ছেলে রাকিব রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের এইচএসসির ছাত্র। ছোট মেয়ে পড়ছে স্থানীয় ইকো-পাঠশালায় চতুর্থ শ্রেণিতে।-এমজমিন
২৭ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ