বিজয় রায় : গত বছরের শেষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাইজির বিয়েতে লাহোরে ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ সেরেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷
আফগানিস্তান সফর শেষে দেশে না ফিরে সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিমানের অভিমুখ ছিল পাকিস্তান, যা নিয়ে গোটা দেশে রাজনীতির পাশাপাশি শোরগোল পড়ে যায় কূটনীতিক মহলেও৷
দিল্লির যুক্তি ছিল, পাকিস্তানকে ভারত যে ‘শত্রু দেশ’ মনে করে না, মূলত সেই বার্তা দিতেই প্রধানমন্ত্রীর এই সৌজন্য সফর৷ কিন্তু সরকারি এই যুক্তিতে মন ভেজেনি বিরোধীদের৷
বরং তাদের প্রশ্ন ছিল, দিনের পর দিন কাশ্মীরে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান৷ এ পরিস্থিতির মধ্যে কী করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সৌজন্য সফর করলেন? কেউ কেউ এমনও প্রশ্ন তুলেছিলেন, আগ্রায় পারভেজ মোশারফকে নিমন্ত্রণ করে এনে যেচে অপমানিত হওয়া এবং লাহোর বাসযাত্রার পর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মোদিজি ভুলে গেলেন কী করে?
এরপর যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির মধ্যে নতুন বছরের শুরুতে জোর ধাক্কা খায় ভারত৷ এ বছরের দোসরা জানুয়ারি পাঠানকোটের বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় চার জঙ্গি৷ এর পেছনে পাকিস্তানের মদদ যে স্পষ্ট পরবর্তীকালের তদন্তে তা জানতে পারে এনআইএ৷
পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয়া হয় সমস্ত নথিও, যা নিয়ে নিজ দেশে সংসদ ভবনেই বিরোধীদের চাপে পড়ে যায় নওয়াজ শরিফের সরকার৷ তা সত্ত্বেও একই বছরের মধ্যে ফের আরও একটি হামলা৷ এবার জঙ্গিদের নিশানায় কাশ্মীরের উরি সেনাঘাঁটি৷ প্রাথমিক তদন্তে এ কাজ পাক মদদগপুষ্ট জয়েশ জঙ্গিদের বলেই প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে৷
ভারতে এখন এই প্রশ্নই বারবার উঠছে, দফায় দফায় হামলা চালিয়েও কেন পার পেয়ে যাবে পাকিস্তান? কেনই বা ভারত মোক্ষ জবাব দেবে না? এহেন পরিস্থিতিতে ভারতের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব শুরু হয়েছে৷
দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর তিন প্রধানের সঙ্গে গোপনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের বৈঠকের পর রণং দেহি মেজাজ আরও জোরদার হয়েছে৷ দেশজুড়ে এখন এমন একটা হাওয়া, যুদ্ধ লাগল বলে৷
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, হাওয়া যাই উঠুক, এ মুহূর্তে কোনও অবস্থাতেই যুদ্ধের পথে হাঁটবে না নরেন্দ্র মোদি সরকার ৷ বরং কূটনৈতিকভাবেই আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানকে আরো একঘরে করার দক্ষ চাল চালতে পারে ভারত৷
যার অনেকটাই দিল্লি এরই মধ্যে করেও ফেলেছে৷ গত শুক্রবার রাষ্ট্রসংঘের সহ-সচিব রাইজার্ড কারনেকি রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভার মঞ্চ থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রীতিমতো তোপ দাগেন৷
তিনি সাফ জানিয়ে দেন, বালুচিস্তানে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, তাহলে যুগপৎ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরোপ করা হতে পারে৷ এ কথা শোনার পরেই ভারতের বিদেশ সচিব সৈয়দ আকবরউদ্দিন সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চ থেকে কার্যত শূন্যহাতেই দেশে ফিরেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি পাকিস্তানের হাত একেবারে শূন্য? কোনো রাষ্ট্রই কি পাকিস্তানের সঙ্গে নেই?
কোনো কোনো মতে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী ভারতের থেকে খানিকটা হলেও এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তান৷ বিশেষ করে আঞ্চলিক রাজনীতিতে মোদিকে খানিকটা পিছিয়েই রেখেছেন নওয়াজ শরিফ৷
ভারতের কাছে পাকিস্তানের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হল চীন৷ উরির ঘটনার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই রীতিমতো প্রেস বিবৃতি দিয়ে ইসলামাবাদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে জি জিনপিংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকার৷
কোনও অবস্থাতেই পাকিস্তানের সঙ্গে তার দেশ যে সম্পর্ক খারাপ করবে না তাও জানিয়েছে চীনা প্রেসি়ডেন্ট জি জিনপিং৷ শুধু তাই নয় কাশ্মীর ইস্যুতেও ইসলামাবাদ-রাওয়ালপিন্ডির সুরই বাজছে বেজিংয়ের গলায়৷
উরিতে সন্ত্রাসবাদী হামলার বহু আগে থেকেই পাকিস্তানকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের যাবতীয় প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে ইন্দোনেশিয়াও৷ আবার ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে যে তারা বদ্ধপরিকর সে কথা জানিয়েছে মাওবাদী প্রচণ্ডর নেপাল সরকার৷
এদিকে কাশ্মীর ইস্যুতে চীনের পাশাপাশি পাকিস্তান পাশে পেয়েছে ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’ তুরস্ককে৷ আঙ্কারার দাবি, ভারতই ‘অনৈতিকভাবে’ কাশ্মীর দখল করে রেখেছে৷ আবার উরিতে সন্ত্রাসবাদী হামলার নিন্দা করলেও মার্কিন প্রশাসনের তরফে কখনই সরাসরি পাকিস্তানের নাম নেয়া হয়নি৷
যদিও ভারতের দাবি, সরাসরি নাম না নিলেও এই হামলার পেছনে যে পাকিস্তানের মদত রয়েছে সেই বার্তাই দিয়েছে ওবামা প্রশাসন৷ অন্যদিকে ভারতের বরাবরের বন্ধু দেশ রাশিয়ার সম্প্রতি গতিবিধি নিয়েও আশঙ্কা বাড়ছে ভারতের কোনও কোনও মহলে৷ গত শুক্রবার পাকিস্তানের তরফে দাবি করা হয়, শিগগিরই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া চালাবে রাশিয়ার সেনাবাহিনী৷
সুতরাং সব দিক থেকে বিচার করে ভারত কূটনৈতিকভাবে সত্যিই কতটা এগিয়ে তা বলা খুব মুশকিল৷ আর তাই ‘মন কি বাতেঁ’র অনুষ্ঠান হোক কিংবা কোঝিকোড়ে বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠক, সব মঞ্চ থেকে ভারতের শাসকপক্ষ পাকিস্তানকে ধমক-চমক দিলেও যুদ্ধের দিকে যে মোদি সরকার পা বাড়াচ্ছে না তা বলা যেতেই পারে৷ তাছাড়া কারগিল যুদ্ধের পরে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের পতনের একটা পূর্বস্মৃতিও রয়েছে৷ সেই ইতিহাস বিজেপি ভুলে যায়নি৷-কলকাতা২৪
২৫ সেপ্টেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম