বুধবার, ০২ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:৪২:২৩

এই কয়েকটি কারণে মার্কিন নির্বাচন বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

এই কয়েকটি কারণে মার্কিন নির্বাচন বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

আরশাদ আলী: মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বের আর মাত্র কয়েকটি দিন বাকি। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের হোয়াইট হাউস ভাগ্য নির্ধারিত হবে ৮ নভেম্বর। অতীতের তুলনায় এবারের মার্কিন নির্বাচন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে হাজির হয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাগ্রহণের পর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তন না হলেও কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষকই। নির্বাচনি প্রচারণায় উভয় প্রার্থীর পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ওঠে আসার পর এমনটা মনে করা হচ্ছে।

অঞ্চল ভেদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ:

এশিয়া
যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার সম্পর্কে এবারের মার্কিন নির্বাচন প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তিন মার্কিন অধ্যাপক। এই তিন জন হলেন, অধ্যাপক অ্যালেন কার্লসন, অধ্যাপক থমাস পেপিনস্কি এবং অধ্যাপক জেসিকা চেন ওয়েইসিস। এরা সবাই একমত যে, নির্বাচনের পরবর্তী সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এশিয়ার সম্পর্কে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।

পেপিনস্কি বলেন, নিশ্চিতভাবেই চীন এবং এশিয়ার মিত্র রাষ্ট্র ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড,  কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রশাসনের সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করবে।

এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে জটিল অবস্থায় আছে নির্বাচনের পর তা আরও বাড়বে বলেও মনে করেন কার্লসন। তিনি বলেন, যে অবস্থায় এশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আছে তার ধারাবাহিকতা শুধু যে অর্থনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে তা নয়, বরং চীন ও অপর দেশগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়েও প্রভাব ফেলবে।

এই তিন অধ্যাপক মনে করেন, মার্কিন নির্বাচন এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর গণতন্ত্রকেও প্রভাবিত করবে। কার্লসনের মতে, এ নির্বাচন যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে কলুষিত করছে তা নয়, বৃহৎ অর্থে তা এশিয়া বিশেষ করে নতুন ও যেসব রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করেছে সেসব দেশকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে।

অধ্যাপক ওয়েইসের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও প্রার্থীদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে চীন। এতেই প্রমাণিত হয় যে চীন উদ্বিগ্ন। তারা নিশ্চিত হতে চাচ্ছে যে, নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে  চীন নিয়ে মার্কিন নীতি পরিবর্তন হবে কিনা।

ইউরোপ
ব্রেক্সিটের পক্ষে ব্রিটিশদের রায় ঘোষণার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র দেশ ব্রিটেন। এছাড়া রাশিয়াকে মোকাবেলায় সামরিক জোট ন্যাটোও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শক্তি। ফলে ইউরোপের জন্য নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও নীতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

ইউরোপে মার্কিন নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে বলে মনে করে ফিনল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্দার স্টাব। নির্বাচনের দুই প্রধান প্রার্থীর পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, একজন অংশগ্রহণ মূলক এবং অপর জন আন্তর্জাতিক। ইউরোপের জন্য অংশগ্রহণমূলক প্রেসিডেন্টই ভালো। একই কথা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকার জন্য প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে প্রয়োজন।

তিনি মনে করেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চাইতে হিলারিই বেশি অংশগ্রহণমূলক হবেন। আর ট্রাম্প যা বলছেন ক্ষমতায় গিয়ে তিনি যদি সত্যিকার অর্থেই তা বাস্তবায়ন করেন তাহলে ইউরোপের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাবেক প্রধান প্যাসকেল লামি মনে করেন, সুরক্ষাবাদী কিংবা নিয়ন্ত্রিত মুক্ত বাণিজ্যপন্থী যে-ই ক্ষমতায় আসুন না কেন তাতে ইউরোপে বেশ বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। ট্রাম্পকে সুরক্ষাবাদী ও হিলারিকে কম মুক্তবাণিজ্যপন্থী বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাদের যে কারও নীতিতেই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য কমে আসবে, তাতে বিশ্ববাণিজ্য প্রভাবিত হবে।  তিনি বলেন, আমার কোনও সন্দেহ নাই যে সুরক্ষবাদ প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে নিম্নগামী করবে। চীন, আফ্রিকা কিংবা ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতির বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মার্কিন অর্থনীতিতে। আর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ভূমিকা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য।

অবশ্য তিনি মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বহুল আলোচিত টিটিআইপি চুক্তি বাধাগ্রস্ত হবে না। একটু সময় নিচ্ছে কিন্তু তা বাস্তবায়িত হবেই।

এছাড়া নির্বাচনের পর রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কও প্রভাবিত হবে। ডেমোক্রেট শিবির ইমেইল ফাঁসের ঘটনা ও ট্রাম্পকে সহযোগিতার জন্য রাশিয়াকে অভিযুক্ত করে আসছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, ওবামার চাইতে পুতিন ভালো রাষ্ট্র নেতা। ফলে এক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্য
ব্রুকিংস গবেষণা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পড়বে প্রত্যক্ষভাবে। ইতোমধ্যে আইএস, সিরিয়া ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিজেদের মত পার্থক্যের কথা জানিয়েছেন হিলারি ও ট্রাম্প। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জায়গা থেকে কিভাবে সিরিয়া সংকট, আইএস মোকাবেল ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা হবে তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই প্রভাব ফেলবে।

প্রতিবেদন অনুসারে, সিরিয়া ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট ওবামার নীতির সমালোচনা করে আসছেন রিপাবলিকানরা। বিশেষ করে আইএস দমনে মার্কিনীতির প্রবল বিরোধিতা করেছেন ট্রাম্প। প্রচারণার শুরুতেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প আইএস দমনে তিনি প্রথমেই তাদের তেলের দখল নেবেন। ট্রাম্প জানিয়েছেন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে উৎখাতের চেয়ে আইএস দমনই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিপরীতে হিলারি চান আইএস দমনের চেয়ে আসাদকে উৎখাতে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। ফলে নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর সিরিয়া ইস্যুতে মার্কিননীতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে। তাছাড়া এই ইস্যুতে মার্কিন নীতি পরিবর্তিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তা প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কেও প্রভাব ফেলবে।

ইরানের ক্ষেত্রে বর্তমান মার্কিন নীতিকে সমর্থন করে আসছেন হিলারি। যদিও পারমাণবিক চুক্তি বাস্তবায়ন করলেও তিনি ইরানকে অন্যান্য ক্ষেত্রে কোনঠাসা করতে আগ্রহী। আর রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প পারমাণবিক চুক্তি বাতিল ও সংশোধন করার পক্ষে। উভয় প্রার্থীই ইরানের ব্যাপারে আরো কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এক্ষেত্রেও নতুন প্রেসিডেন্টের হাত ধরে সম্পর্কে নতুন মোড় নিতে পারে।

ইরানের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ইরানকে কোনঠাসা করতে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবসহ বেশকিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখছে। তাছাড়া বর্তমানে ইয়েমেনকে কেন্দ্র করে সৌদি-ইরান সম্পর্কে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ফলে ইরান বিষয়ে মার্কিন নীতির পরিবর্তন হলে তার প্রভাব পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই পড়বে।

মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। হিলারির ফিলিস্তিন বিরোধিতা এবং ইসরায়েলের প্রতি আস্থার কথা বেশ প্রকাশ্য। ট্রাম্প ফিলিস্তিন প্রশ্নে মার্কিন নীতি পর্যালোচনার পক্ষে। ফলে এক্ষেত্রেও নতুন প্রেসিডেন্টের নীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।

লাতিন আমেরিকা
তেল সমৃদ্ধ লাতিন আমেরিকার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ও ভূমিকা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডরসহ কয়েকটি দেশে মার্কিনবিরোধী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নিজ স্বার্থ রক্ষায় লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া লাতিন আমেরিকার মাদকযুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্রের মদত দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

সেন্টার ফর ইকনমিক অ্যান্ড রিসার্চ প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক নীতির সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট আলেক্সান্ডার মাইন মনে করেন, রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেট কোনও দলেরই লাতিন আমেরিকার মাদকযুদ্ধের বন্ধের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। তার মতে, যে দলেরই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন অভিবাসী ইস্যুতে কিছুটা উন্নতি হবেই। কারণ ভোটের ক্ষেত্রে লাতিনদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে কংগ্রেস ও সিনেটে যদি রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তাহলে লাতিন আমেরিকার কয়েক লাখ অবৈধ অভিবাসীদের অবস্থান করা কঠিন হতে পারে।

লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে নির্বাচনের বিরাট ভূমিকা থাকবে বলে মনে করেন আলেক্সান্ডার। তিনি মনে করেন, ট্রাম্প মুক্ত বাণিজ্যের বিরোধিতা করে আসছেন। আর হিলারি এটার পক্ষে অনেক আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছেন। এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি না হলে লাতিন আমেরিকার অর্থনীতির জন্য বেশ ভালো হবে।

যদিও অভিবাসী ইস্যুতে নিজের বিতর্কিত অবস্থানের কারণে লাতিন আমেরিকায় জনপ্রিয়তা একেবারেই কম ট্রাম্পের। ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্টে রাফায়েল কোরেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, লাতিন আমেরিকার জন্য ট্রাম্পের চেয়ে হিলারিই মঙ্গলজনক।

বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন নির্বাচন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন, এশিয়ায় দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে চীন ও আমেরিকা পরস্পরবিরোধী মুখোমুখি অবস্থানে। আন্তর্জাতিক আদালত দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একক মালিকানার দাবি নাকচ কর দিয়েছে। হোয়াইট হাউসে নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর আমেরিকা দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেবে। উত্তর কোরিয়া নতুন নতুন মিসাইল পরীক্ষা করে ও পারমাণবিক শক্তি অর্জনের ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররাষ্ট্রকে হুমকি দিয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর কার্যক্রম মোকাবেলায় নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। নতুন প্রেসিডেন্ট স্পর্শকাতর এসব ইস্যুতে যদি  বল প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তাহলে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা আরও বাড়বে। ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশ্ব অর্থনীতি এমনিতেই অনিশ্চিত সময় পার করছে। নতুন যে কোনও সংঘাত ও যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও ঝুঁকির মুখে টেলে দেবে। বিপরীতে সুচিন্তিত নীতি-কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার সুযোগও রয়েছে। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন,ব্রুকিংস এডু, অ্যালাইননেট, ইউরো নিউজ।
২ নভেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে