বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:০১:৫১

আপনি মিথ্যুক, আপনার লজ্জা নেই : ক্ষুব্ধ ট্রাম্প

আপনি মিথ্যুক, আপনার লজ্জা নেই : ক্ষুব্ধ ট্রাম্প

নাজমুল আহসান : বহু নাটকীয়তার পর অবশেষে প্রখ্যাত মার্কিন সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমসের দপ্তরে পত্রিকাটির প্রকাশক, সম্পাদক, কলামিস্ট ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এর আগে দেশের শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেলের তারকা উপস্থাপক ও নির্বাহীদের সঙ্গে নিজের মালিকানাধীন ট্রাম্প টাওয়ারে সাক্ষাৎ করেন তিনি। ওই সাক্ষাতের বিষয়বস্তু ছিল ‘অফ-দ্য-রেকর্ড’। অংশগ্রহণকারীরাও চুক্তিতে সম্মত হন যে, তারা আলোচনার বিষয়বস্তু অন্যত্র প্রকাশ করবেন না। তবে তা প্রকাশ পেয়ে যায়। নিউ ইয়র্ক পোস্ট জানায়, নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে নেতিবাচক কাভারেজ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন ট্রাম্প। শুরুটা করেন সিএনএন’র প্রেসিডেন্ট জেফ জাকারকে নিয়ে।

তাকে বলে উঠেন, ‘আপনার নেটওয়ার্ককে আমি ঘৃণা করি। সিএনএন’র প্রত্যেকে মিথ্যুক। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।’ এর কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, ‘মিথ্যুক, শঠ, অসৎ মিডিয়ায় ভর্তি একটা রুমে আমরা বসে আছি।’ এসব শুনে উপস্থিত সাংবাদিকরা হতভম্ভ হয়ে পড়েন। বৈঠকের পর ট্রাম্পপন্থি ওয়েবসাইট আর পোর্টালগুলোতে রীতিমতো জয়োল্লাস দেখা যায়। যেমন, ড্রুজ রিপোর্ট নামে একটি পোর্টালের শিরোনাম ছিল: ‘মিডিয়া এলিটদের সামনা-সামনি ধুয়ে দিলেন ট্রাম্প’!

ও পথে হাঁটেনি নিউ ইয়র্ক টাইমস। ট্রাম্প শিবির থেকে যখন সাক্ষাতের প্রস্তাব এলো, তখন পত্রিকাটি ট্রাম্পের ‘অফ-দ্য-রেকর্ড’ আলোচনার শর্ত মানেনি। পত্রিকাটি আগে ভাগেই জানিয়ে দেয়, আলোচনা হবে ‘অন-দ্য-রেকর্ড’।

তবে প্রকাশকের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত ‘অফ-দ্য-রেকর্ড’ আলোচনা মেনে নেয়া হয় টাইমসের পক্ষ থেকে। ট্রাম্প শিবিরও রাজি হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ট্রাম্প দাবি করেন, টাইমস নতুন শর্ত দিয়ে আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে। টাইমস এ দাবি অস্বীকার করে বিবৃতি দেয়। পরে জানা যায় বিষয়টা ছিল ভুল বোঝাবুঝি।

অবশেষে টাইমস কার্যালয়ে এসে সাক্ষাৎ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। এ সাক্ষাতের সংক্ষিপ্ত ধারাবর্ণনা উপস্থিত প্রতিবেদকরা নিজেদের টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেন। এ টুইট আবার সঙ্কলিত আকারে প্রকাশ করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। পুরো কথোপকথনই পরে হুবহু নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে পত্রিকাটি।

এখানে মনে রাখা উচিত, নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের ‘নেতিবাচক’ কাভারেজ নিয়ে ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন ট্রাম্প। পত্রিকাটির বিরুদ্ধে তিনি প্রচুর টুইট করেছেন। প্রত্যেকবার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ‘ফেইলিং’ বিশেষণটি। এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও টাইমসের সমালোচনা করা বন্ধ করেননি ট্রাম্প।

গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা টাইমসের অবস্থানের প্রশংসা করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টে মার্গারেট সুলিভান লিখেছেন, টিভি সাংবাদিকদের মতো একই ফাঁদে পা দেয়নি ‘দ্য গ্রে লেডি’। ট্রাম্পের ‘অফ-দ্য-রেকর্ড’ আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ও স্বচ্ছভাবে সংবাদ হিসেবে বৈঠকটিকে কাভার করে সঠিক কাজটিই তারা করেছে। এর মাধ্যমে সংবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি ট্রাম্প। সিএনএন এক প্রতিবেদনে বলেছে, টাইমসের সাংবাদিক, সম্পাদক ও কলামিস্টদের সঙ্গে ৭৫ মিনিট ধরে বৈঠক করেন তিনি।

এ সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বেশ কয়েকটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিশেষ করে নির্বাচনী প্রতিপক্ষ হিলারি ক্লিনটনকে জেলে পুরার যে হুমকি দিয়েছিলেন, তা থেকে সম্পূর্ণ সরে গেছেন তিনি। ওয়াটারবোর্ডিং-এর মতো নির্যাতনের কৌশল পুনঃপ্রবর্তনের প্রতিশ্রুতিতেও ইউটার্ন নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পদে থাকা আবার নিজের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য পরিচালনা করা- এ দু’কাজ করতে গিয়ে স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) তৈরি হবে কিনা এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।

পাশাপাশি তিনি নিও-নাৎসি গোষ্ঠীগুলোর দায় নিতে অস্বীকার করেছেন, যদিও নিন্দা জানাননি। নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন ও ফরেইন পলিসি ম্যাগাজিন অবলম্বনে সাক্ষাৎকারের ৬টি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো।

বিভীষণদের ভুলেননি ট্রাম্প : ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি তার সুর ছিল নরম। প্রচারাভিযান চলাকালে প্রতিপক্ষ হিলারি ক্লিনটনকে জেলে ঢুকানোর হুমকি দিলেও, সে-ই অবস্থান থেকে তিনি সরে এসেছেন। তিনি বলেন, ক্লিনটন পরিবারের ক্ষতি করার ইচ্ছা নেই তার। আর করলে, তা হবে ‘দেশের জন্য খুবই, খুবই বিভেদজনক’। পাশাপাশি তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ হয়ে উঠেন। বলেছেন, ওবামার ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার পরিচালনা দেখে তিনি সন্তুষ্ট। ব্যক্তিগতভাবেও ওবামাকে পছন্দ তার।

তার ভাষ্য- ‘আমি জানতাম না যে, আমি তাকে পছন্দ করবো কিনা। আমি হয়তো ভেবেছিলাম যে, আমি করবো না। কিন্তু বাস্তবে আমি পছন্দ করেছি। আমি তার কথা অনেক উপভোগ করেছি।’ নিউ ইয়র্কের জ্যেষ্ঠ সিনেটর ও ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেট প্রধান চাক শামার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি চাক শামারকে অনেকদিন ধরে পছন্দ করে আসছি।’ দৃশ্যত, ডেমোক্রেটদের নিয়ে তার অসন্তোষ অতটা নেই। কিন্তু নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির যেসব নেতা তার কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন, সেসব বিভীষণদের তিনি ভুলেননি।

গর্বসহকারে তিনি বলেন, আমি অনেক সিনেটরকে জিততে সাহায্য করেছি। নিউ হ্যাম্পশায়ারের সিনেটর কেলি আয়োত্তের সমালোচনা করেন তিনি। নির্বাচনের সময় আয়োত্তে ট্রাম্পের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। পরে সামান্য ব্যবধানে হেরে যান। তিনি নেভাদার কংগ্রেসম্যান জো হেককে নিয়েও মজা করেন।

হেকও ট্রাম্পের বিরোধিতা করে নির্বাচনে হেরে যান। কংগ্রেসে রিপাবলিকান নেতা হাউস স্পিকার পল রায়ান ও সিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা মিচ ম্যাককনেলকে নিয়েও সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখান তিনি। তার ভাষ্য, ‘এখন তারা আমার প্রেমে মুগ্ধ। কিন্তু ৪ সপ্তাহ আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না।’

স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট নিয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিয়ে নিজের ব্যবসা পরিচালনা করলে তা স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করবে কিনা। জবাবে সরাসরি কিছু না বলে তিনি বলেন, ‘আইন আমার পক্ষে আছে। প্রেসিডেন্টের কোনো স্বার্থের সংঘাত থাকতে পারে না।’

সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে অনেকটা একই কথা বলেছিলেন আমেরিকার ইতিহাসে অভিসংশিত হওয়া একমাত্র প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। তিনি বলেন, সংজ্ঞানুসারে, একজন প্রেসিডেন্টের কার্যক্রম আইন ভঙ্গ করে না। তিনি বলেন, ‘যখন প্রেসিডেন্ট কিছু করেন, তার মানে হলো এসব অবৈধ নয়।’ সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প স্বীকার করেন যে, তার বিজয়ের ফলে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাভ হয়েছে।

নিজেই বলেছেন, ওয়াশিংটনে তার একটি হোটেল এখন হয়তো আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি মূল্যবান। কিন্তু তিনি বলেন, ব্যবসা নিয়ে তার অত আগ্রহ নেই আর। ব্যবসার দায়িত্ব তিনি সন্তানদের হাতে ছেড়ে দেবেন। এমজমিন
২৪ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে