সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৮:৪৭:৫৮

জাতিসংঘসহ কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে না মিয়ানমার!

জাতিসংঘসহ কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে না মিয়ানমার!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের নির্মূলের অভিযান অব্যাহত রেখেছে। সেনাবাহিনীর হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মুখে রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিনই শত শত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিতে নদী ও সাগর পথে পাড়ি জমাচ্ছে। তারপরও মিয়ানমারের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও বিশ্ব সম্প্রদায় আহ্বান জানিয়ে চলেছে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ নিশ্চিত করতে। কিন্তু যেন কানে তুলো দিয়ে আছে মিয়ানমার সরকার। কারো আহ্বানকেই পাত্তা দিচ্ছে না তারা। বরং সবার ডাক উপেক্ষা করে তাদের কঠোর নীতিতে অটল রয়েছে মিয়ানমার।

গত অক্টোবরে একাধিক পুলিশ ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করে। তারপর থেকেই দেশটির বঞ্চিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ঢালাও হামলা, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটাচ্ছে সেনাবাহিনী। যদিও এসব অভিযোগ সেনাবাহিনী বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা বলছে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর অভিযানে ৮৬ রোহিঙ্গা মারা গেছে। সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর রাখাইন প্রদেশে সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রবেশের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবন-যাপন করলেও তাদের জন্য মানবিক সাহায্য পর্যন্ত যেতে দিচ্ছে না সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগের মধ্যেই এবার মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচিকে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে যেতে বলেছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গা নির্যাতনের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকায় অনেকেই দেশটির গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চির সমালোচনা করছেন। এমনকি তার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয়ারও দাবি উঠেছে সামাজিক গণমাধ্যমে।

গত বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ পরামর্শক বিজয় নাম্বিয়ার সু চির প্রতি সরাসরি আহ্বান জানিয়ে বলেন, মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা না নিয়ে অভিযান শুরু করায় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। সু চিকে বলছি, মংডু এবং বুথিডংয়ে গিয়ে সেখানকার বেসামরিক জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। রাখাইনের ওই দুই এলাকা বর্তমানে অবরোধ করে রেখেছে সেনাবাহিনী। সু চির পক্ষ থেকে এখনও এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুকে তিনি বারবারই অত্যন্ত ‘স্পর্শকাতর’ বলে উল্লেখ করে আসছেন। গত সপ্তাহে অং সান সু চি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করে বলেছিলেন, বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কে তারা উস্কানি দিচ্ছে।

বিভিন্ন দেশও রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতিতে ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবেতর অবস্থায় থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি মানবিক সাহায্য পাঠানোর সুযোগ করে দিতে ইতোমধ্যে মিয়ানমারের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ১৪ দেশ। মিয়ানমারে অবস্থিত তুরস্ক, অস্ট্রিয়া, বেলিজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, স্পেন, সুইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, মিয়ানমারের বন্ধু দেশ হিসেবে রাখাইনের মানবিক বিপর্যয় নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কাছে মানবিক সাহায্য ঢুকতে না দেয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এসব দেশের রাষ্ট্রদূতরা। তাদের অভিযোগ- সামরিক কর্মকর্তারা প্রায়ই সেখানে সাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করছেন অথবা বিলম্বিত করছেন। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, রাখাইনে তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুসহ হাজার হাজার মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিপীড়নের সমালোচনা হচ্ছে বিশ্বব্যাপীও। ইতোমধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করে তাদের নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য দেশটির কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের কাছে জরুরি মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের ৭০ জন পার্লামেন্ট সদস্য। ৭০ জনের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী টুইটারে খবরটি নিশ্চিত করেছেন। টুইটারে বিবৃতিটিও পোস্ট করেছেন তিনি। বিবৃতিতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর সাম্প্রতিক নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা মিয়ানমার সীমান্তে সাম্প্রতিক সহিংসতার নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে লক্ষ্য করে সহিংসতার অবসান চাই। রোহিঙ্গাদের কাছে পূর্ণাঙ্গ মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর অনুমোদন দিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারেরও অবশ্যই যোগ দেয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন তারা। সহিংস পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের যথাসম্ভব সহায়তার জন্যও আহ্বান জানান তারা।

বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নাগরিক অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত। দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা চলে আসছে রাখাইন বৌদ্ধ ও রাজ্যটিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে। দেশটিতে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়, এমনকি দেশটির সরকার তাদের প্রাচীন নৃ-গোষ্ঠী হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়নি। এর আগে ২০১২ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের নিপীড়নের মুখে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়। এখনো অনেক রোহিঙ্গা দেশটির জরাজীর্ণ ক্যাম্পে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। মোট রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখের মতো হলেও এখন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে অন্যদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি রাখাইন রাজ্যে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তবে জাতিসংঘ এরইমধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার অভিযোগ এনেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ না করলে রোহিঙ্গারা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলেই মনে করছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।-ইত্তেফাক
১২ ডিসেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে