মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০৪:৩২

রোহিঙ্গা গণহত্যার করুণ কাহিনী, জীবন্ত শিশুকে পুড়িয়ে হত্যার বর্ণনা দিলেন মা

রোহিঙ্গা গণহত্যার করুণ কাহিনী, জীবন্ত শিশুকে পুড়িয়ে হত্যার বর্ণনা দিলেন মা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : নভেম্বরের কোন এক গভীর রাত। ২৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী আরাফা তার পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ছোট একটি ডিঙ্গি নৌকায় করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করেন।

বাংলাদেশের টেকনাফে অবস্থিত অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরের জীর্ণ এক কুটিরে বসে তিনি ভয়ঙ্কর কাহিনী বলছিলেন। এক ছেলে ও চার কিশোরী কন্যাকে নিয়ে মাঝে বসেছিল আরাফা। তার সন্তানেরা একগুচ্ছ প্রাণবন্ত শিশু। তারা বিশ্রামহীন, এখনো লাজুক। কখনো তারা তাদের মায়ের পিছনে লুকাচ্ছে কিংবা কুঁড়ে ঘরের বাইরে অন্য শিশুদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করছিল।

আরাফা তার পাঁচ সন্তানকে বর্মি সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচাতে পারলেও তার আরেক ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি। তার দ্বিতীয় ছেলের ভাগ্যে কি ঘটেছিল যেমনটি সে বর্ণনা করছিল।

আরাফা বলেন, ‘সে ছিল আট বছর বয়সী। ২২ নভেম্বর তাদের গ্রামে বর্মি নিরাপত্তা বাহিনী আক্রমণ করে।’

তিনি জানান, সেনাবাহিনীর হামলার ধরন তার কাছে কিছুটা ভিন্ন অনুভূত  হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আরো বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, উৎসাহিত মনে হয়েছে।

আরাফা জানান, সেনারা তার গ্রামে অগ্নিসংযোগ করলে আগুন তার বাড়ি গ্রাস করে। তিনি তার ছয় সন্তানকে নিয়ে কোন রকমে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

এক পর্যায়ে বর্মি সৈন্যদের মুখোমুখি হলে তারা তার আট বছর বয়সী ছেলেকে কেড়ে নেয়। পরে তাকে তার ভাই ও বোনদের কাছ থেকে পৃথক করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।

এর আগে এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে আরাফা তার স্বামীকে হারান। এখন তার সেখানে ফিরে যাওয়ার অবস্থা নেই। ছেলের দগ্ধ মৃতদেহসহ সে তার সব কিছুই সেখানে ফেলে এসেছেন। বিলাপ করার মতো ভাষাও যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।

আরাফা টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘আমি আমার অন্য শিশুদের বাঁচাতে বার্মা থেকে পালিয়ে এখানে এসেছি। ওরা আমাদের সব পুড়িয়ে দিয়েছে।’

একটি ক্ষীণ নৌকায় আরোহনের আগে আরাফা তার সন্তানদের নদীর তীরবর্তী একটি জঙ্গলে টানা দুই দিন লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে তিনি জানান।

তার ভাষায়, ‘নাফ নদী যদি কথা বলতে পারত, তাহলে সে এই ভয়াবহ কাহিনীর কথাই প্রথম তুলে ধরত।’ কিন্তু নাফ নদী কি পারবে তাদের এই নিষ্ঠুর গল্প স্মরণ রাখতে?

শুধু আরাফা নয়, তার মতো হাজার হাজার নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ  একটু আশ্রয়ের খুঁজে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশে ছুটছে। মায়ানমারের সেনাদের নির্মম অত্যাচারে গত দুই মাসে প্রায় ২১,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। যেটিকে তারা ‘চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলে বিবৃতি দিয়েছে।

রোহিঙ্গাদেরকে মায়ানমার সরকার অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করে এবং তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ও বৌদ্ধ চরমপন্থীদের হাতে নিপীড়ন, ভীতিপ্রদর্শন ও সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে।

গত ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন প্রদেশের মংডু এবং পার্শ্ববর্তী রাতেডং শহরের তিনটি চৌকিতে অজ্ঞাত পরিচয়ধারীদের হামলায় ১৩ জন সীমান্তরক্ষী নিহত হয়।

এ ঘটনার জন্য রোহিঙ্গা মুসলমানদের অভিযুক্ত করে তাদের গ্রামগুলোতে অভিযান শুরু করে মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, অভিযানের নাম করে মায়ামার সেনাবাহিনী, বিজিপি ও পুলিশের নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানা হচ্ছে। তারা নারীদের পাশবিক নির্যাতন, হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

এ পর্যন্ত অন্তত ২৫০ জন রোহিঙ্গা নিহত, সহস্রাধিক গ্রেপ্তার এবং বহু নারী ও কিশোরী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় সকল প্রকার নাগরিক ও মৌলিক সুবিধা হতে বঞ্চিত রোহিঙ্গারা। মায়ানমারে ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য পরিচয় পত্র থাকাটা খু্ব জরুরি বিষয়। কিন্তু মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পরিচয় পত্র ইস্যু করে না, ফলে, এমনিতেই পিছিয়ে পড়া রোহিঙ্গারা আরো পিছিয়ে পড়ছে।

মায়ানমার সরকারের ভূমি ও সম্পত্তি আইন অনুসারে বিদেশিরা কোন সম্পত্তি ও ভূমি মালিক হতে পারে না। রোহিঙ্গারা মায়ানমার সরকারের দৃষ্টিতে অবৈধ অভিবাসী তথা, বিদেশি। তাই, রোহিঙ্গারা কোন ভূমি বা, স্থায়ী সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বর্তমানে যেসকল ভূমিতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে, মায়ানমার সরকার যেকোন মুহুর্তে সেগুলো দখল করে নিতে পারে।
 
মায়ানমার সরকার আইনের মাধ্যমে রীতিমত অসহনীয় করে তুলেছে রোহিঙ্গাদের জীবন। রোহিঙ্গারা সরকারি চাকরি করতে পারে না, সরকারি কোন দপ্তরে রোহিঙ্গা কোন সেবা পায় না, ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না, সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের সেবা গ্রহণ করতে পারে না, উপযোগ সেবার (বিদ্যুত, পানি, জ্বালানী) জন্য আবেদন করতে পারে না, স্বপরিচয়ে শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। প্রায় ৮০% রোহিঙ্গা বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত।

প্রায়ই মায়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা নিপীড়নের খবর পাওয়া যায়। রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে খাটানো হয়। প্রায়শ স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দেয়। শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধন, সরকারি জমি অধিগ্রহণের নামে রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়। এর মধ্যে প্রাচীন কিছু মসজিদও আছে। অনেক রোহিঙ্গাদের ব্যবসায় দখল/বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য ‘গ্যাটো' জাতীয় বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ কয়েকটি বিশেষ বসবাসের স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা থেকে ওরা অনুমতি ছাড়া বের হতে পারে না। সেই গ্যাটোগুলোর ভিতরে আবদ্ধ মানবেতর জীবনযাপন করে রোহিঙ্গারা। চিকিৎসা, শিক্ষা ও উপযোগ সেবার ব্যবস্থা এই গ্যাটোগুলোতে থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ও নিম্নমানের।

রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার জন্যও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নেয়া লাগে। এছাড়া দুটোর বেশি সন্তান নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করায় ও দুজনের বেশি সন্তানের জন্ম দেয়ায় রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তানদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার। এইসব পরিবারের সন্তানরা সরকারের ‘গ্যাটো ব্যবস্থা' তালিকাভুক্ত নয়, ফলে, এদের জীবন ফোঁড়ার উপরে বিষ ঘা এর মত। এরা গ্যাটোগুলোতে থাকতে পারে না।

আবার, গ্যাটোর বাইরেও থাকতে পারে না, কারণ, মায়ানমারের নাগরিক নয় ওরা। অবস্থাটা ওদের এমন যে, মায়ানমার সরকার ওদের কোন অস্তিত্বই স্বীকার করে না। এইসব পরিচয়হীন রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের পথে পা বাড়ায়। নৌপথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা ঢুবে মারা গেছে।

বিগত কয়েক দশক ধরে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশ ইন করছে। রুটিনমাফিক নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে। বর্তমানে সাত লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় বসবাস করছে। যদিও রিফিউজি হিসেবে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরো কম।

রোহিঙ্গাদের প্রতি যা করছে মায়ানমার সরকার, তা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধেই অপরাধ। এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আরাকানে বিকশিত হতে থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সুবিধা না দেয়া, গ্যাটো সৃষ্টি করে সেখানে অমানবিক পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা, বিচারবর্হিভূতভাবে গ্রেপ্তার করা, মালিকানাস্বত্ব, সার্বজনীন শিক্ষা, চিকিৎসা, উপযোগ সেবা ও মৌলিক মানবাধিকার হতে বঞ্চিত করার মাধ্যমে নিমর্মতার শেষ সীমানাটুকু অতিক্রম করেছে মায়ানমার সরকার।

মায়ানমার সরকারের নিপীড়ণের সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। রোহিঙ্গা বিরুদ্ধে রাখাইনসহ অন্যান্য বৌদ্ধ আরাকানীদের উস্কানি দিচ্ছে মায়ানমার সরকার। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে বৌদ্ধ মৌলবাদকে সরাসরি ইন্ধন ও মদদ যোগাচ্ছে মায়ানমার সরকার।

মায়ানমার সরকারের মনে রাখা দরকার, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মাঝে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, সুসংগঠিত অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। রোহিঙ্গাদের ক্রমাগত নিপীড়ণ করে ওদেরকে চরমপন্থার দিকেই ক্রমশ ঠেলে পাঠাচ্ছে মায়ানমার সরকার।

২০১২ সালে রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা শত শত রোহিঙ্গা নিহত হয় এবং প্রায় ১,৪০,০০০ রোহিঙ্গাকে স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত করা হয়। আনুমানিক ১,০০,০০ মানুষ দারিদ্র্যপীড়িত ক্যাম্পে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও দাতব্য সংস্থার উপর নির্ভরশীল হয়ে বসবাস করছে।
১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে