মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৭:১৭:৫৪

মাননীয় সু চি, এবার তবে নোবেলটা ফিরিয়ে দেবেন কি?

মাননীয় সু চি, এবার তবে নোবেলটা ফিরিয়ে দেবেন কি?

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়: ভারতের প্রতিবেশী এক দেশেও স্বচ্ছতা অভিযান চলছে। নোংরা বা কালো টাকা সাফাই নয়, ভিনধর্মী মানুষদের সাফাই। খানিক--, খানিক অত্যাচার, খানিক বিতাড়ন। মায়ানমারের উত্তরে রাখাইন প্রদেশ এখন জ্বলছে। সেই প্রদেশে যাঁরা থাকেন তাঁদের একটা বড় অংশ রোহিঙ্গিয়া। ওঁরা মুসলমান। মায়ানমারে অন্যদের কাছে পরিচিত ‘বাঙালি’ বলে। সে দেশের সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের বিলকুল না-পসন্দ তাঁরা। সুতরাং দেশের শুদ্ধিকরণ জারি রয়েছে। নতুন কিছু নয়। ২০১২’তেও অত্যাচার চলেছিল, ডাক্তার-ওষুধ-খাবার পাঠানো বন্ধ হয়েছিল, গণমাধ্যমকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এবং প্রচুর রোহিঙ্গিয়া পালিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী বাংলাদেশে, তাইল্যান্ডে, মালয়েশিয়ায়, ইন্দোনেশিয়ায়। সেনা সরকার বলেছিল, এ সব অপপ্রচার।

কিন্তু শত চেষ্টাতেও এ বার এই সাংঘাতিক অত্যাচার চেপেচুপে রাখা যাচ্ছে না। গত ৯ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গিয়া অত্যাচারিত হচ্ছেন দেশের সামরিক বাহিনীর হাতে। কী হয়েছিল ৯ অক্টোবর? ভেতরের পুরো খবর তো পাওয়া যাবে না, কারণ বাইরের গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের আধিকারিকেরও ঢোকা নিষেধ। খবর যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সংক্ষেপে এই দাঁড়ায় যে, রোহিঙ্গিয়া সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর একটি অংশ নাকি ওই দিন মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করে। ন’জন পুলিশ অফিসার ও পাঁচ জন সেনার মৃত্যু হয়। এবং তার পর থেকে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। নিতেই তো হবে, বিশেষ করে তাঁরা যখন দেশের নাগরিক নন!

রোহিঙ্গিয়াদের দাবি, তাঁরা মায়ানমারের নাগরিক। কিন্তু মায়ানমার সরকার দীর্ঘ কাল ধরেই বলে আসছে, রোহিঙ্গিয়ারা বাংলাদেশি রিফিউজি। ১৯৮২ সালে মায়ানমারে একটি নতুন আইনে রোহিঙ্গিয়াদের নাগরিকত্বকে অস্বীকার করা হয়। তার পর থেকেই তাঁরা আশ্রয় নিতে শুরু করেন বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে। বাংলাদেশে চলে যান প্রায় দেড় লক্ষ রোহিঙ্গিয়া। এখনও সে দিকেই ঝোঁক বেশি, কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে পাহারা কড়া হয়েছে। কারণ এখন সে দেশেও রোহিঙ্গিয়ারা অবাঞ্ছিত। আর তাই শীর্ণকায় নৌকায় চাপাচাপি করে যে আশা আসছিল বাংলাদেশের দিকে, তাকে তীর থেকে তরী ঘোরাতে হয়েছে শূন্যের দিকে। মালয়েশিয়াতেও প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গিয়া শরণার্থী হয়ে চলে গেছেন। পড়শি তাইল্যান্ড আর ইন্দোনেশিয়াতেও। স্বস্তি কোথাও মেলেনি। আর অন্য দিকে, প্রায় তেরো লাখ রোহিঙ্গিয়া রয়ে গেছেন মায়ানমারে, তার মধ্যে ১১ লাখ রাখাইন প্রদেশে। তাঁদের ওপর চলছে বেদম অত্যাচার। রাষ্ট্রপুঞ্জ হুঁশিয়ারি দিয়েছে— মায়ানমারে যা হচ্ছে, তাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলার দরকার হতে পারে।

এরই মাঝে এক জন মাত্র মানুষ স্থিতধী, অবিচল। অশান্ত অবস্থা সম্পর্কে মাত্র দু’একটা মন্তব্য খরচ করেছেন, তা-ও পাশ কাটানো। তিনি আউং সান সু চি। গত বছর নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দলের জয়ের পরে বকলমে সরকার তিনিই চালাচ্ছেন। ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার, তার ক্ষমতা যতটুকুই হোক না কেন। মায়ানমার দীর্ঘদিন ছিল সরাসরি সামরিক বাহিনীর দখলে। বিশেষ করে ১৯৮৮ সাল থেকে ফৌজি নায়কদের বজ্র আঁটুনি চেপে বসেছিল। ২০১১ সালে পরিস্থিতি একটু বদলায়, ক্ষমতায় আসে আধা-সামরিক সরকার। তাঁর দেশের নিপীড়িত মানুষকে অ-গণতন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবেন বলেই সু চি আন্দোলন করেছেন, গৃহবন্দি থেকেছেন টানা পনেরো বছর। তিনিই তো মসিহা, যাঁর ভরসার আঁচল ধরতে চেয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। অথচ, নিপীড়িত রোহিঙ্গিয়াদের বিষয়ে তিনি এত উদাসীন! তাঁরা কি নিপীড়িত নন? তাঁরা কি সাধারণ মানুষ নন? তাঁরা কি দেশের মানুষ নন? এই শেষ প্রশ্নটিই অমোঘ। রোহিঙ্গিয়ারা মায়ানমারের নাগরিক নন, তাঁরা বাঙালি, রিফিউজি— মনে করে এসেছে মায়ানমারের সামরিক ও আধা-সামরিক সরকার, আর এখন মনে করছে সু চি-র সরকার। ফলে মানবাধিকারের বিশ্ববন্দিত প্রতিমা সু চি’র আঁচলের ছায়ার বাইরে রোহিঙ্গিয়ারা। তাঁরা বেওয়ারিশ।  

অন্য সরকার কী করেছে, কী করেনি, সে প্রশ্ন থাক। কিন্তু সু চি-র সরকার থাকাকালীন এমন মানবতা-বিরোধী কাজ হয়েই চলেছে, আর তিনি মৌনী! সু চি-র আজীবন লড়াই ছিল মানবাধিকারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। অন্তত বিশ্ববাসী তা-ই জেনে এসেছিল। তাঁর সেই লড়াই যে কেবল বাছাই সংখ্যগরিষ্ঠদের জন্য, এমনটা তো তারা জানত না। অথচ তিনি যে কেবল রোহিঙ্গিয়াদের উপর গণ-অত্যাচারের সামনে নীরব থেকেছেন তা-ই নয়, যে কয়েকটি মন্তব্য করেছেন তাতে স্পষ্ট যে, তিনি রোহিঙ্গিয়াদের সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মায়ানমারবাসীর কাছে, এমনকী তাঁর দলের লোকজনের কাছেও অপ্রিয় হতে চান না।

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজেতা সু চি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গিয়ারা তো বাঙালি। ওরা আদৌ এ দেশের নাগরিক কি না দেখতে হবে।’ এবং বলেছেন, ‘ওদের প্রতি যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা আইনসঙ্গত।’ দেখতে হবে? আউং সান সু চি, দেখতে হবে? আপনি কি এত দিন তা হলে বেছে বেছে মানবাধিকারের লড়াই লড়ছিলেন? মানবাধিকারের প্রথম কথাই তো হল, যে কোনও পরিচয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রতিটি মানুষ, কেবল মানুষ হিসেবেই কিছু মৌলিক অধিকার পাওয়ার যোগ্য! ভেদাভেদ বিচার করে তো মানবাধিকারের হয় না!

আর আইন? এই গণ-অত্যাচার যদি মায়ানমারের আইন অনুযায়ী হয়, তা হলে সু চি আইন-অমান্য আন্দোলন করছেন না কেন? করেননি কেন? গাঁধীজি ব্রিটিশ রাজের আইন অমান্য করেছিলেন, কারণ তাঁর মতে আইনটাই অন্যায় ছিল। গোড়ায় নাড়া দিয়েছিলেন গাঁধীজি। সু চি পারলেন না কেন? তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন হারানোর ঝুঁকি আছে, তাই?

হয়তো আমরাই বুঝতে পারিনি, প্রথম থেকেই সু চি তাঁর লক্ষ্যে অচল ছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে। নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গিয়াদের ওপর অত্যাচার সম্পর্কে নীরব থাকার সময় সু চি যা বলেছিলেন তার অর্থ— রোহিঙ্গিয়াদের ক্ষুদ্র স্বার্থ দেখতে গেলে গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘুদের সমস্যা ভাল করে বিচার করে দেখবেন এবং সুরাহা করতে পারবেন। এখন তিনি ক্ষমতায়। রোহিঙ্গিয়াদের ক্ষুদ্র স্বার্থ দেখার সময়, অবকাশ, মন ও সাহস— কোনওটাই তিনি জুটিয়ে উঠতে পারেননি। বরং স্বর আরও নামিয়েছেন। বলেছেন, ‘মায়ানমারের মতো দেশে অন্যায়-অত্যাচার এত তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’ রোহিঙ্গিয়া প্রশ্নে এই নীরবতা এবং নিষ্ক্রিয়তাই তবে তাঁর ধর্ম। বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি নীরব ছিলেন ক্ষমতা না পাওয়ার ভয়ে, এখন তিনি ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নিষ্ক্রিয়।

তা হলে তিনি কেমন নেত্রী! নোবেল শান্তি কমিটি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা তিনি’। কিন্তু বাস্তবে তিনি ক্ষমতাশীলের হাতের পুতুল হয়ে ক্ষমতাহীনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়লেন! অথচ সারা বিশ্ব সু চিকে বন্দনা করে এসেছে নিপীড়িত মানুষের প্রতিভূ হিসেবে। আশায় থেকেছে, যে দিন সু চি ক্ষমতায় আসবেন, মানুষের দুঃখদুর্দশা কমতে আরম্ভ করবে। কিন্তু সেই মানুষের মধ্যে যে তাঁর স্বদেশের সংখ্যালঘুদের স্থান হবে না, এমন কথা তো ছিল না।

মায়া হয় সু চি-র জন্য। সত্যিকারের নেত্রী হওয়ার সুযোগ ছেড়ে, হলেন স্রেফ এক রাজনীতিবিদ? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়ে গণতন্ত্রের সঙ্গেই দ্বিচারিতা করলেন? সংখ্যালঘুদের দূরে ঠেলে দিয়ে সংখ্যাগুরুদের তুষ্ট করে শাসন বজায় রাখাটা কট্টর সংখ্যাগুরুবাদ, (এখন যার জনপ্রিয় নাম জাতীয়তাবাদ) গণতন্ত্র নয়। ভোটের আগে গণতন্ত্রের কথা বলা যত সহজ, হাতে ক্ষমতা পেয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশ্বাসকে সত্যিকারের গণতন্ত্রে— যে গণতন্ত্রে সমাজের সমস্ত ধরনের মানুষের অধিকার থাকবে— পরিণত করা তার চেয়ে অনেক কঠিন। এবং মাননীয়া সু চি, এ পরীক্ষায় আপনি বেবাক ফেল করেছেন। আপনার জীবনগাথায় ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক’— এই গৌরবময় তথ্যের পরের লাইনেই লেখা থাকবে, মায়ানমারে আপনার আমলে মানবাধিকার ভয়াবহ ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছিল।

আসলে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ভার খুব বেশি। সে ভার বহন করার সামর্থ্য আপনার নেই। এটাই সত্য। এ সত্য বড় কষ্টের— আস্থা ভেঙে যাওয়ার কষ্ট। এবং বিস্ময়ের— যা কিছু সতত, ধ্রুব, তা আচমকা নেই হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ বিস্ময়, যা আত্মস্থ করতে এক জীবন বিশ্বাসকেই বার বার প্রশ্ন করতে হয়।-আনন্দবাজার
১৩ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটি নিউজ২৪ ডটকম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে