সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০১৭, ০১:০২:৪১

এশিয়ান নারীকে আয়া ভাবার কারণ কী?

এশিয়ান নারীকে আয়া ভাবার কারণ কী?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিবিসির সরাসরি সম্প্রচারিত খবরে এক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য নেয়ার সময় সম্প্রতি এক হাস্যরসাত্মক ঘটনা ঘটে। ঘরে নিজের কক্ষে বসে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করতে বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলেন। উত্তর কোরিয়ার মতো গুরুতর বিষয়ে তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে নাচতে নাচতে কক্ষে ঢুকে পড়ে তার ছোট মেয়ে।

কিছুক্ষণ পর ঢুকে পড়ে আরো ছোট এক বাচ্চা। টের পেয়ে ভেতর থেকে একজন মহিলা হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে ঢুকে পড়েন। আর বাচ্চাদের একরকম জোর করেই ভেতরে টেনে নিয়ে যান। উত্তর কোরিয়া ইস্যুর মতো গুরুতর বিষয়ে সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত আলোচনার সময় এমন ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ হাস্যরস সৃষ্টি করেছে। কিন্তু নিরীহ মজা এখন মোড় নিয়েছে আরো গুরুতর এক বিতর্কে।

সোস্যাল মিডিয়ায় ওই ঘটনার ভিডিও শেয়ার হয়েছে প্রায় কোটি বার! কিন্তু শেয়ারকারীদের অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন এশিয়ান মুখোবয়বের ওই নারী হলেন ঘরের আয়া! তারা ঘটনার বর্ণনার সময় তাকে আয়া বলেই সম্বোধন করেছিলেন। মজা করে অনেক ব্যবহারকারী এই ‘আয়া’র চাকরি থাকবে কিনা তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু কেন আয়া?

তিনি তো ওই ভদ্রলোকের স্ত্রীও হতে পারেন। কেন এশিয়ান নারীকে ওই শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপকের স্ত্রী ভাবতে পারেননি অনেক দর্শক? এশিয়ান হওয়ার অর্থ কি এই যে, তিনি গৃহকর্মীই হবেন? শুধু সাধারণ লোকজনই নয়। অনেক প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যমের খবরেও ওই মহিলাকে আয়া বলেই পরিচয় দেয়া হয়েছে! বাস্তবে জানা গেল, ওই নারী আসলে শ্বেতাঙ্গ প্রফেসরের স্ত্রী।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয়েছে বর্ণ, লিঙ্গ ও মিশ্র বর্ণের জুটিদের নিয়ে মানুষের অনুমান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক। এটি ঠিক যে, দক্ষিণ কোরিয়ার অনেকেই ঘরে শিশুদের দেখাশোনার জন্য আয়া রাখেন। অনেক এশিয়ান, বিশেষ করে ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার নারীরা অনেক দেশে গৃহকর্মীর কাজ করেন। কিন্তু কাউকে আয়া ধরে নেয়ার আগে দু’বার ভাবতে তো হবে। সেটিই অনেকে দেখানোর চেষ্টা করছেন।

অনেক এশিয়ান এখন এ ধরনের পূর্বধারণার বশবর্তী হয়ে টানা উপসংহারের শিকার হওয়ার গল্প বলছেন। এ ধরনের আচরণ কি বর্ণবাদী নয়? প্রশ্ন কারও কারও। বিবিসির প্রতিবেদক হেলিয়ের চুং নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, জেনে হোক, আর না জেনে হোক, এ ধরনের ঘটনা ঘটে। লন্ডনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই চীনা বংশোদ্ভূত বৃটিশ সাংবাদিক বলেন, চীনা চেহারার হওয়ায় অনেকে ধরে নিতো আমি মেডিকেল বা অর্থনীতি নিয়ে পড়ছি! অথচ, আমি পড়তাম ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। এটি হয়তো গুরুতর ইস্যু নয়, কিন্তু অনেকের জন্য মানুষের এই পূর্বানুমান বয়ে এনেছে আরো পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা।

যেমন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক সাংবাদিক একটি স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করতে গেলে, ওখানকার রিসেপশনিস্ট ধরে নিয়েছিলেন যে, তিনি একজন ক্লিনার! এমনকি ওই সাংবাদিককে রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেসও করে বসেন, আপনি কি রান্নাঘর পরিষ্কার করতে এসেছেন? জাপানি বংশোদ্ভূত শিক্ষাবিদ কুমিকো টোডা বলেন, তার জন্ম যুক্তরাজ্যে, শৈশবও সেখানে। কথাবার্তাও বলেন চোস্ত বৃটিশ উচ্চারণে। কিন্তু তার সঙ্গে কারও সাক্ষাৎ হলেই প্রথম প্রশ্নটি শুনতে হয়, ‘আপনি এসেছেন কোন দেশ থেকে?’

ওই প্রফেসরের স্ত্রীকে গৃহকর্মী বা আয়া ভাবার পেছনে আরেক কারণও থাকতে পারে। যেমন, জেনে হোক, না জেনে হোক, মানুষ ধরেই নেয় যে, এক জাতির মানুষ ওই জাতির বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গেই প্রেম করবে। বিবিসি প্রতিবেদক হেলিয়ের চুং বলেন, আমি একটি কনসার্টে গিয়েছিলাম তিন পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে। এদের দু’জন শ্বেতাঙ্গ বৃটিশ, আরেকজন চীনা বংশোদ্ভূত বৃটিশ। আর যাদের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে তারা ভেবে নিয়েছেন যে, আমি বুঝি ওই চীনা পুরুষ সঙ্গিটির সঙ্গেই প্রেম করছি!

টিফানি অং ও জোনাথন স্মিথ নামে বৃটিশ এক জুটি জানান নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা। তারা বলেন, এমনও হয়েছে যে রাস্তায় চলার সময় লোকজন উল্টোপাল্টা মন্তব্য করেছে। যেমন, স্মিথকে একজন বলেছিল যে, ‘তুমি এক এশিয়ান মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছো! মানাচ্ছে না!’ এমনকি তাদের প্রেমের কথা শুনে নিজ পরিবার ও সহকর্মীদের অনেকেও অবাক হয়েছিলেন।

তবে বর্ণ সম্পর্কিত এ ধরনের পূর্বানুমান সবসময় একই ধরনের হয় তা নয়। ফিলিপাইনের গৃহকর্মী হেলেন (ছদ্মনাম) কাজ করেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। তিনি বলেন, কিছু কোরিয়ান শরীরের চামড়ার রঙ নিয়ে ভীষণ খুতখুতে। ফিলিপাইনি ও কোরিয়ানদের চেহারার অবয়ব অনেকটা একই রকম হলেও, হেলেন মনে করেন কিছু কোরিয়ান তাদের চেয়ে কিছুটা কম সাদা চামড়ার লোকদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করেন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় দুই বছর ধরে বিবিসির সাংবাদিক ছিলেন অ্যান্ড্রু উড। তিনি বৃটিশ শ্বেতাঙ্গ। কিন্তু তিনি জানান, তাকেও শিকার হতে হয়েছে এমন পূর্বানুমানের। যেমন, দক্ষিণ কোরিয়ায় তাকে প্রায়ই ধরে নেওয়া হতো যে তিনি বুঝি পাশের মার্কিন সামরিক ঘাঁটির কোন সেনা! তার ভাষ্য, ‘শুক্রবার বা শনিবার রাতে কোন শ্বেতাঙ্গ ট্যাক্সি পেত না! কারণ, ট্যাক্সি চালকরা ধরেই নিতো যে, এই ব্যাটা নিশ্চিত কোন মাতাল মার্কিন সেনা। তাকে ট্যাক্সিতে উঠালেই পেছনে কিছুক্ষণ পর বমি করে দেবে।’এমজমিন
১৩ মার্চ ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে