মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০১৭, ০১:১৬:১৩

মূর্তিপুজায় বিশ্বাসী আমরা, মানুষকে কী করে ভালবাসবো?

মূর্তিপুজায় বিশ্বাসী আমরা, মানুষকে কী করে ভালবাসবো?

ঈশানী দত্ত রায় : শনিবার থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে নরেন্দ্র মোদির পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছিলেন ভারতের লৌহমানবী ইরম শর্মিলা চানুও। কারও মন্তব্য, 'রাখি সাবন্তের চেয়েও কম ভোট পেলেন শর্মিলা। ওয়েলকাম টু রিয়্যালিটি'! কেউ লিখেছেন, 'মণিপুরের মানুষ, শর্মিলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে ! এবার আফস্পা নিয়ে পচে মরো'!

বিশ্বাসঘাতকতা ! সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন তোলার দাবিতে ১৬ বছরের অনশন যেদিন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন শর্মিলা, সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাকে বিশ্বাসঘাতক মনে করছে মণিপুর। ভারতের মণিপুর রাজ্যের  ইম্ফলের জওহরলাল নেহরু হাসপাতালের বাইরে তাবু খাটিয়ে যে মহিলারা দিনের পর দিন রিলে অনশন করেছেন সংসারের পরোয়া না-করে, তারাও মনে করছেন, শর্মিলা বিশ্বাসঘাতক। বাস্তববাদীরা জানতেন, তার ভোটে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত, মুখ্যমন্ত্রিত্বের স্বপ্ন সফল হবে না। একে তো মানুষের চোখে তিনি খলনায়ক, তার উপর জোরদার সাংগঠনিক শক্তিও নেই। কিন্তু তাই বলে মাত্র ৯০টি ভোট?

শর্মিলা বোঝেননি, শুধু আবেগ দিয়ে সংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে নির্বাচন জেতা যায় না। ভেবেছিলেন, আফস্পা তোলার জন্য অনশন তাকে মণিপুরের মানুষের মনে এমন জায়গা দিয়েছে যে, তিনি হারাতে পারবেন বিতর্কিত মুখ্যমন্ত্রীকেও। ভুল ভেবেছিলেন। আসলে ১৬ বছর ধরে তার অনশনের মূর্তিটিকে, জীবনের সব চাহিদাকে আন্দোলনের পায়ে জলাঞ্জলি দেওয়াকেই জনগণ সম্মান করেছিল।

তার বিয়ে, সংসারের চাহিদা তাদের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা! তাই বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্তরা জিতে গেলেও তিনি পান মাত্র ৯০টি ভোট। আসলে, যিনি একটি অগণতান্ত্রিক আইন প্রত্যাহারের জন্য অনশন করেন এবং 'শহিদ' হন, তাকে ফুলপাতা দিয়ে পুজো করতে ভালই লাগে। কিন্তু সেই মূর্তি যে আদতে মানুষ, সে কথা আমরা ভুলে থাকতেই ভালোবাসি। কারণ, আমাদের বিশ্বাস, বিগ্রহের বা জননায়কের রক্তমাংসের চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে না।

'উত্তরফাল্গুনী' ছবির সংলাপ মনে পড়ছে। নায়িকা প্রেমিককে বলছেন, ''তুমি কী পেলে, মণীশ? তোমার ঘর হল না, সংসার হল না, সন্তান হল না ! সারা জীবন তুমি একা, নিঃসঙ্গ !'' সেই প্রেমিককেই তো আমরা ভালবাসি সেলুলয়েডের জগতে, সহমর্মী হই। বাস্তবেও তাই। শর্মিলা তো বলেছেন যে, তার কেন্দ্রে মানুষ সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, কিন্তু ভোট দেননি !

শর্মিলার অপরাধ, তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন তার উপর চাপিয়ে দেওয়া 'দেবীত্বে'র বিরুদ্ধে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই আন্দোলনের মুখ একমাত্র তিনি, তাই তাকে আন্দোলন থেকে বেরোতে দেওয়া হবে না। তবু তিনি প্রাচীর ভাঙলেন, বেরোলেন এবং একা হয়ে গেলেন। তার প্রেমিক ডেসমন্ড কুটিনহো (শর্মিলার আন্দোলন ভাঙতে কেন্দ্র তাকে নিয়োগ করেছে বলেই অনুরাগীদের দীর্ঘদিনের ধারণা) মোক্ষম সময়ে বিরূপ মন্তব্য করলেন অনুগামীদের বিরুদ্ধে। লড়াই কঠিন হল শর্মিলার।

তবু টাকা, পেশি, এবং সংগঠিত শক্তির নির্বাচনে মণিপুরের মানুষকে একতরফা দোষ দেওয়া যায় কি? আসলে নিজের দেশের সেনাবাহিনীই যেখানে নাগরিকের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে থাকে, সেখানে নেত্রীর সরে যাওয়া কেমন লাগে, তা নিশ্চিন্ত শহরে বসে বোঝা যায় না। তবু, তবু মন থেকে সরছে না ওয়েবসাইটে দেখা ছবিটা ! সাইকেলে প্রচার করছেন শর্মিলা। একা। আর মনে পড়ছে শর্মিলার টুইট-
'থ্যাঙ্কস ফর নাইনটি ভোটস'!
আমাদের সকলের গালে সপাট একটি চড়! সূত্র : এবেলা।
১৪ মার্চ ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে