শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭, ০৩:৩০:২৫

মমতাকে ফাঁদে ফেলছেন মোদী, যে ৩টি বিপদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন

মমতাকে ফাঁদে ফেলছেন মোদী, যে ৩টি বিপদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল সরকারকে হঠানোর স্বপ্ন দেখছেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই লক্ষ্যে মমতাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন এমন রাজনীতির ফাঁদে, মমতাও বাধ্য হচ্ছেন সেখানে পা ফেলতে।

শুক্রবারই তৃণমূলের সাংগঠনিক নির্বাচন হয়ে গেল। প্রত্যাশিতভাবেই কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাংগঠনিক নির্বাচনের মঞ্চ থেকে সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কথা বলবেন বা কিছু রদবদল হবে নেতৃত্বে, এমন প্রত্যাশাও ছিল অনেকের মনে। বিশেষত ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে নেওয়ার কথা মমতা ঘোষণা করবেন বলেও জল্পনা ছিল।

কিন্তু শুধুই সুব্রত বক্সীকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করে, আর কয়েকটি রাজ্যে কারা কারা পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করবে, এইটুকু বলেই সাংগঠনিক কথা শেষ করেছেন মমতা। বাকিটা আগামী ১০-১৫ দিনে ঘোষণা করবেন বলেই জানিয়েছেন। মমতার ভাষণের সিংহভাগ জুড়ে নারদ কাণ্ড ও বিজেপি-র আক্রমণের মুখে দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করার কথাই ছিল।

আসলে গত মাস খানেক ধরে বিজেপি মমতাকে এমন এক রাজনীতির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যে রাজনীতি তাঁকে সরকারে আসার পরে কখনও করতে হয়নি। মূলত দু’টি বিপদ মমতার সামনে।
সিবিআই তদন্ত

এমন নয় যে সিবিআই তদন্তে তৃণমূলের কোনও নেতা আগে গ্রেফতার হননি, বা কাউকে জেরা করা হয়নি। কিন্তু একেবারে ১২ জন মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়কের বিরুদ্ধে সিবিআই-এর এফআইআর দায়ের করা মমতার কাছে বড় ধাক্কা। এদেরকে গ্রেফতার করা হলে তা আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে মমতার জন্য।

যাঁদের বিরুদ্ধে নারদ-কাণ্ডে এফআইআর করা হয়েছে, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা। এই নেতারা গ্রেফতার হলে তৃণমূল নেত্রী বড়ই চাপে পড়বেন।

এমনটা নয় যে, সেই ঘটনার ফলে তাঁর সরকার পড়ে যাবে। এর আগেও সারদ-রোজভ্যালি চিটফান্ড কাণ্ডে তৃণমূল নেতারা গ্রেফতার হলেও বা নারদ-অভিযোগ থাকলেও, নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে মুখ্যমন্ত্রীর কোনও সমস্যা হয়নি। এখনও জনসমর্থনে কোনও ধস নামেনি। কিন্তু এই অভিযুক্ত নেতারা গ্রেফতার হলে প্রবল চাপ নিয়ে মমতাকে কাজ করতে হবে।

মমতা দাবি করছেন, নারদ তদন্তে সিবিআই যা করছে, তা মোদী সরকারের অঙ্গুলীহেলনেই। সিবিআই-কে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘পোষা নেংটি ইঁদুরও’ বলেছেন। ঠিক যেভাবে পূর্বতন সরকার সিবিআই-কে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করত, ঠিক সেই ভাবেই মোদী-শাহরা এই গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করবে বলেই মমতার আশঙ্কা।

এর ফলে মমতার দলের কর্মীদের যেমন মনোবল ভেঙে যাবে, তেমনই কর্মী-নেতারা নিজেদের বাঁচাতে বিজেপি-র দিকে ঝুঁকে পড়বেন বলে আশঙ্কা দলের অন্দরেই।

বিজেপি নেতৃ্ত্বও এই অবস্থার ফায়দা তুলছে। মমতাকে তাঁরা যত আক্রমণ করছেন, ততই মমতা দলের নেতাদের ‘বাঁচাতে’ তৎপর হয়ে উঠছেন। আপাতত রাজ্যের উন্নয়নের কথা যত না বলছেন, তার চেয়েও বেশি বলছেন নারদ-তদন্ত কতটা বিজেপি-র চক্রান্ত এবং তাঁর দলের নেতারা কতটা নির্দোষ, সেই কথা।
হিন্দু-রাজনীতি

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে বোধহয় এতবার বলতে হয়নি, ‘আমি হিন্দু’, যতবার তিনি এই কথাটি গত এক মাসে বলেছেন। রামনবমী নিয়ে মাস খানেক ধরে যে শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে, তার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি মমতা।

সরকারি সভা থেকে হোক বা দলের সম্মেলন অথবা পাশের রাজ্য ওড়িশা — সব জায়গায় দাঁড়িয়ে মমতাকে প্রকাশ্যে বারবার বলতে হচ্ছে ‘আমি হিন্দু’। বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মূল পরিসরে হিন্দুত্বের রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দিয়েছে। মমতার প্রতিক্রিয়া দেখেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

শুক্রবারও নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সভা থেকে যে বক্তব্য রাখলেন, তার সিংহভাগ জুড়ে মমতা ‘হিন্দু’ রাজনীতির কথাই বললেন। তা কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, তা নিয়ে দলের কর্মীদের নির্দেশও দিলেন। এর আগে মমতা বলতেন, তাঁর সরকার কত উন্নয়নের কাজ করেছে, তার ফিরিস্তি নিয়ে দরজায় দরজায় যেতে। এখন বলছেন হিন্দুত্বের রাজনীতির কারবারিরা বাইরের রাজ্য থেকে লোক নিয়ে আসছে, তাদের উপর নজর রাখতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গে মমতার সংখ্যালঘু তোষণ নিয়ে রাজনৈতিক কথা অনেক শোনা গিয়েছে। কিন্তু উত্তর ভারতের মতো শুধুই হিন্দুত্বের রাজনীতি সেভাবে এই রাজ্যে হয়নি। মমতা বিজেপির সেই পাতা ফাঁদেই পা দিয়ে ফেলেছেন।  

মমতার রাজনীতিতে উত্থানের মূলে রয়েছে তীব্র সিপিআইএম-বিরোধিতা। জ্যোতি বসু হোন বা বুদ্ধদেব, এঁদের বিরোধিতা করেই রাজনীতি করে গিয়েছেন মমতা। মূল কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দল গড়া বা ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসা, মমতার যুদ্ধের মূল প্রতিপক্ষই ছিল সিপিআইএম।

সেই সিপিআইএম-এর শক্তিক্ষয় হয়ে যাওয়ায় মমতা তাঁর রাজনীতির প্রতিপক্ষই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রায় ৬ বছর সরকারে থাকার পর, সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে পুরনো কথা ছাড়া নতুন কথা মমতার মুখে আর নেই।

এবার তিনি নরেন্দ্র মোদীকে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ বলে মনে করছেন। একপ্রকার বাধ্য হচ্ছেন। ভোটের অঙ্কে এ রাজ্যে বিজেপি অনেক পিছিয়ে থাকলেও, দক্ষিণ কাঁথির উপনির্বাচন মমতার জন্য অশনি সংকেত বয়ে আনছে। বিরোধী বাম শিবিরের ভোট বিজেপি-তে চলে যাচ্ছে দেখে, বামেদের ভোটব্যাঙ্কে যাতে আর ধ্স না নামে, তা দেখতেও একপ্রকার উদ্যোগী হয়েছেন মমতা।

তাঁর বিরোধী হিসেবে বিজেপি অনেক শক্তিশালী। এই দল একটি দেশের সরকার চালাচ্ছে। এদের সংগঠন ও সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠন এক যোগে কাজ চালালে, তা অনেক সুসংগঠিত আক্রমণ গড়ে তুলবে মমতার বিরুদ্ধে। সবার উপরে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্যারিশমা। তাই বিরোধী হিসেবে বিজেপি যে মমতাকে আরও চাপে ফেলবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তাই মমতাকে এখন বেশির ভাগ সময় বুদ্ধ-বিমানের কথা ছেড়ে নরেন্দ্র মোদীর কথাই বলতে হয়। মোদীর বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলিকে একজোট করতে ছুটে বেড়াতে হয় তৃণমূল নেত্রীকে।

বিজেপি-র মতো সংগঠিত শক্তির সঙ্গে লড়াই মমতার পক্ষে কঠিনতর হবে। ধীরে ধীরে মমতাকে এই খাদের কিনারেই নিয়ে আসছে বিজেপি। বারবার মমতা খাদের মুখ থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এবার এই লড়াইয়ে মমতার একমাত্র পুঁজি পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত তাঁর অটুট ভোটব্যাঙ্ক ও উন্নয়নের ফিরিস্তি। কিন্তু সেই ফিরিস্তি শোনানোর মতো সময় পাচ্ছেন কোথায় মুখ্যমন্ত্রী?-এবেলা
২২ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে