আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইতালির বিখ্যাত মহিলা সাংবাদিক ওরিয়ানা ফ্যালাসির সঙ্গে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার। ওরিয়ানা ফ্যালাসির বই থেকে নেওয়া:
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: মিসেস গান্ধী, আপনার কাছে সমাজতন্ত্রের অর্থ কী?
ইন্দিরা গান্ধী: ন্যায়বিচার। হ্যাঁ, এর অর্থ ন্যায়বিচার। এর অর্থ সমতাপূর্ণ সমাজে কাজ করার চেষ্টা করা।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: কিন্তু বাস্তবে কোনো প্রকার আদর্শ হতে বিমুক্ত হওয়া।
ইন্দিরা: হ্যাঁ। আমার নিজের একটা আদর্শ আছে- কেউ শূন্যে কাজ করতে পারে না। তোমাকে অবশ্যই কোনো কিছুতে বিশ্বাসী হতে হবে। আমার বাবা বলতেন, তোমার মনটাকে অবশ্যই খোলা রাখতে হবে। কিন্তু মনের মধ্যে কিছু রাখতে হবে। তা না হলে ধ্যান-ধারণাগুলো আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে বালির মতো গড়িয়ে পড়বে। কথা হলো আমার একটা আদর্শ আছে, কিন্তু আমি গোঁড়া নই।
এখন গোঁড়া থাকা যায় না। বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে। এমনকি কুড়ি বছর আগে তুমি যা চাইতে এখন তা সঙ্গতিহীন, পরিত্যক্ত। ভারত এখনো দারিদ্র্যপীড়িত। স্বাধীনতার কোনো সুফল জনগণের বিরাট অংশ আজো পায়নি- তাহলে মুক্ত হয়ে কী লাভ? আমরা কেনই বা মুক্ত হতে চেয়েছিলাম? শুধু কি বৃটিশকে তাড়াতে? এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট।
আমরা সব সময় বলেছি যে, উপনিবেশবাদের প্রতিনিধি বৃটিশের বিরুদ্ধেই শুধু আমাদের সংগ্রাম নয়, আমাদের সংগ্রাম ভারতে বিরাজমান সব অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে। সমস্ত ব্যবস্থার ত্রুটি, বর্ণ প্রথা বা অর্থনৈতিক অবিচারের ফলে সৃষ্ট সমস্যা ভারতে মারাত্মক দুষ্টগ্রহ। এসব কিছুই নির্মূল হয়নি। কুড়ি বছর পর আমরা রাজনৈতিকভাবে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু আমরা যে লক্ষ্য স্থির করেছিলাম তা অর্জিত হয়নি।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: তাহলে আপনি কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছেন?
ইন্দিরা: এটা বলা শক্ত। তুমি কি কখনো পর্বতারোহণ করেছো? কোনো পর্বতের শিখরে উঠলে মনে হবে তুমি সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছো। কিন্তু সে ধারণা বেশিক্ষণ টিকে না। শিগগিরই দেখবে, তুমি যে শিখরে উঠেছো তা খুব নিচু। উঁচু শিখরে উঠতে হলে বহু পর্বতে আরোহণ করতে হবে। উঁচুতে উঠতে থাকলে উঠতে ইচ্ছা হবে।
আমি বলতে চাই, ভারতে দারিদ্র্যের বহু দিক রয়েছে। শুধু শহুরে দারিদ্র্য নয়, উপজাতিগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য রয়েছে, বনে-জঙ্গলে, পার্বত্য এলাকায় বহু দরিদ্র লোকের বাস। শহরের দরিদ্র লোকেরা ভালো আছে বলে কি আমরা তাদের অবহেলা করতে পারি? যখন কেউ একটা দেশ শাসন করে, বিশেষ করে ভারতের মতো বিশাল ও সমস্যাপূর্ণ দেশে কিছুই হাসিল করা যায় না। এরই মধ্যে একটা স্বপ্নের দিকে এগুতে হবে, এত দূর যে, কোনো দিন সে পথের শুরু বা শেষ হয়নি।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: মিসেস গান্ধী, আপনি সে পথের কোথায় উপনীত হয়েছেন?
ইন্দিরা: খুব গুরুত্বপূর্ণ একপর্যায়ে। ভারতীয়রা যে কিছু করতে পারে সে ব্যাপারে আমি আশ্বস্ত। প্রথমে লোকজন আমাদের বলতো, ‘আপনারা কি এটা করতে পারবেন?’ আমরা চুপচাপ থাকতাম, কারণ আমরা নিজেদের বিশ্বাস করতাম না। আমরা যে কিছু করতে পারবো সে বিশ্বাস আমাদের ছিল না।
এখন আর কেউ বলে না, ‘পারবেন কি?’ বরং বলে, ‘কখন কাজটা করবেন?’ ভারতীয়রা শেষ পর্যন্ত নিজেদের বিশ্বাস করছে যে, তারা কিছু করতে পারে। ‘কখন’ শব্দটি একজন মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ব্যক্তি যদি কখনো ভাবে যে সে কিছু করতে পারবে না, তাহলে তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না। সে যদি খুব বুদ্ধিমান বা মেধাসম্পন্ন হয়, তবুও না। সামর্থ্য হওয়ার শর্ত হলো নিজের ওপর আস্থা।
জাতি হিসেবে আজ আমরা আস্থাশীল করতে পেরেছি। তারা এখন গর্বিত। কেউ এই গর্ব আরোপ করতে পারে না এবং সহসা ভেঙেও যায় না। এটা একধরনের অনুভব, যা ধীরে ধীরে জন্মায়। আমাদের যা গর্ব-অহঙ্কার তা জন্মেছে গত পঁচিশ বছরে। অন্যেরা এটা বুঝতে না পেরে ভুল ধারণা পোষণ করে। পাশ্চাত্যের লোকেরা ভারতীয়দের প্রতি কখনো উদার ছিল না। ধীরে ধীরে সবকিছু বদলাচ্ছে তা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছো। কিছু একটা ঘটেছে- খুব বেশি নয়, কিন্তু কিছু।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: মিসেস গান্ধী, আপনি নিজেই তো যথেষ্ট অহংকারী।
ইন্দিরা: না, আমি অহংকারী নই।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: অবশ্যই আপনি অহংকারী। ১৯৬৬ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বিশ্ব যে সাহায্যের প্রস্তাব করেছিল তা নিতে অস্বীকৃতি জানানো অহংকার নয়? আমার মনে আছে একটি জাহাজ শস্য, খাদ্য বোঝাই করা হয়েছিল, কিন্তু সেটি শেষে বন্দর ত্যাগ করেনি এবং সব সামগ্রী পচে গেছে। অন্যদিকে ভারতের লোকজন মারা যাচ্ছিল।
ইন্দিরা: এ ঘটনা আমি কখনো শুনিনি। আমি জানি না যে, জাহাজটা বোঝাই করে ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিল- তাহলে হয়তো নিতে অস্বীকার করতাম না। তবে এটা সত্য যে, আমি বিদেশি সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছিলাম। এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল না। গোটা দেশই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিশ্বাস করো, এটা ঘটেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
জনগণ, সকল রাজনৈতিক দল পার্লামেন্টের ডেপুটিরা পর্যন্ত বিদেশি সাহায্যের বিরোধী ছিল। ভিক্ষুকের জাতি হিসেবে পরিচিত হওয়ার চেয়ে ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ উত্তম- এই ছিল চেতনা। যারা আমাদের সাহায্য দিতে চেয়েছে তাদের কাছে এই চেতনা ব্যাখ্যা করেছি। আমি জানি এতে তোমরা আহত হয়েছো। অনেক সময় কিছু না বুঝে আমরা একে অন্যকে আহত করি।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: আমরা আপনাকে আহত করতে চাইনি।
ইন্দিরা: আমি জানি এবং বুঝি তোমাকেও অবশ্যই আমাদেরকে বুঝতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে তোমরা বলেছো, ‘সংঘাত ছাড়া কি করে যুদ্ধ সম্ভব?’ আমরা তো কোনো সংঘাত ছাড়াই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তোমরা বলেছো, ‘অশিক্ষিত জনগণ, যারা ক্ষুধায় মরছে, সেখানে কী করে গণতন্ত্র চর্চা হবে?’ কিন্তু আমরা সেই জনগণ দিয়েই কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি।
তোমরা বলেছো, ‘পরিকল্পনা হয় কমিউনিস্ট দেশের জন্য। গণতন্ত্র ও পরিকল্পনা পাশাপাশি চলতে পারে না।’ কিন্তু সব ভুল-ভ্রান্তির মধ্যে আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়েছে। এরপর আমরা ঘোষণা করেছি, ভারতে মানুষ আর অনাহারে থাকবে না। তোমাদের সাড়া ছিল, ‘অসম্ভব। তোমরা কখনো সফল হবে না।’ কিন্তু আমরা সফল হয়েছি। এখন ভারতে না খেয়ে কেউ মরে না।
খাদ্য উৎপাদন চাহিদা অপেক্ষা অধিক। সবশেষে আমরা জন্মহার সীমিত রাখতে প্রতিজ্ঞা করেছি। তোমাদের তাও বিশ্বাস হয় না, অবজ্ঞার হাসি হাসো। গত দশ বছরে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে সাত কোটির ওপরে। কিন্তু এই হার অনেক দেশের চেয়ে কম।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: সাধারণত কি ভয়াবহ পদ্ধতিতে, পুরুষের নিবীর্যকরণের মতো। আপনি কি তা অনুমোদন করেন?
ইন্দিরা: সুদূর অতীতে ভারতে যখন জনসংখ্যা কম ছিল, তখন নারীকে আশীর্বাদ করা হতো, ‘তোমার অসংখ্য সন্তান হোক।’ আমাদের অধিকাংশ মহাকাব্যে ও সাহিত্যে এর ওপর জোর দেয়া হয়েছে এবং আজো নারীর যে অসংখ্য সন্তান হওয়া উচিত, এ ধারণা দূর হয়নি। আমার অন্তরও বলে, মানুষ যত সংখ্যক সন্তান কামনা করে তাই হওয়া উচিত। কিন্তু এটা ভ্রান্ত ধারণা। আমাদের সহস্র বর্ষ ধরে লালিত অনেক ধারণার মতো এ ধারণারও মূলোচ্ছেদ করতে হবে। পরিবার, সন্তানদের রক্ষা করতে হবে।
শিশুদের দৈহিক ও মানসিক পরিচর্যা করতে হবে। তুমি কি জানো, এখনো দরিদ্র লোকেরা সন্তানদের জন্ম দেয় তাদের দায়িত্ব নেয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কি করে এই প্রাচীন ব্যবস্থাকে সহসা বলপূর্বক পরিবর্তন করা সম্ভব? একমাত্র উপায় পরিকল্পিত জন্ম। পুরুষকে নিবীর্যকরণ জন্ম নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি। অত্যন্ত নিরাপদ ও উন্নত পদ্ধতি। তোমার কাছে ভয়ঙ্কর। যথাযথভাবে এটা করলে মোটেই ভয়ঙ্কর নয়। যে লোকটি আট বা দশটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে তাকে নিবীর্যকরণের মধ্যে দোষের কিছু দেখি না। বিশেষ করে এর ফলে সেই আট বা দশটি সন্তানের জীবন যদি উন্নত হয়।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: আপনি কি কখনো নারীমুক্তির পক্ষে ছিলেন, মিসেস গান্ধী?
ইন্দিরা: না, কোনোদিন না। আমার প্রয়োজন হয়নি। আমি যা করতে চেয়েছি, সব সময় তা করতে সক্ষম হয়েছি। আমার মা নারীমুক্তির পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন নারী হওয়াটা সবচেয়ে ঝামেলার। তার নিশ্চয়ই যুক্তি ছিল। তার সময়ে নারীকে পর্দার অন্তরালে থাকতে হতো। ভারতের প্রায় সকল রাজ্যেই তারা রাস্তায়ও বেরুতে পারতো না। মুসলিম নারীদের পর্দা প্রথা পালন করতে হতো।
হিন্দু নারীদের ডোলিতে চড়ে বাইরে বেরুতে হতো। আমার মা অত্যন্ত তিক্ততার সঙ্গে এসব বলতেন। দুই বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড় এবং ভাইদের সঙ্গে তিনি বড় হয়েছেন প্রায় দশ বছর পর্যন্ত। এর পর তাকে বাধ্য করা হলো নারীর লক্ষ্য অনুসরণ করতে, ‘এটা করা ঠিক নয়’ ‘ওটা ভালো নয়’। ‘নারীর জন্য কাজটা অনুচিত’- ইত্যাদি।
একটা বিশেষ সময়ে তার পরিবারকে জয়পুর চলে যেতে হলো। সেখানে নারীর পক্ষে পর্দা এড়িয়ে চলা সম্ভব ছিল না। তাকে সকাল হতে রাত অবধি ঘরের মধ্যেই থাকতে হতো- রান্নাবান্না করে অথবা কিছুই না করে। তিনি কিছু না করাকে ঘৃণা করতেন, রান্নার কাজও ঘৃণা করতেন। অতএব ফ্যাকাশে ও অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং ঠাকুরদা বলতেন, ‘এখন কে ওকে বিয়ে করবে?’ আমার ঠাকুরমা অপেক্ষা করতেন কখন ঠাকুরদা বাইরে যায়।
বাইরে চলে গেলেই তিনি মাকে ছেলের পোশাক পরিয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে সাইকেল চালাতে দিতেন। ঠাকুরদা কখনো এটা জানতে পারেননি এবং ঠাকুরমা একটুও না হেসে আমাকে গল্পটা বলতেন। এই অবিচারের স্মৃতি তার মন থেকে কখনো মুছে যায়নি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মা নারীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন। নারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তিনি এক মহান নারী, বিরাট ব্যক্তিত্ব।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: আপনি তাদের সম্পর্কে কী ভাবেন, মিসেস গান্ধী? আমি বলতে চাই, তাদের মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে?
ইন্দিরা: এটা খুব ভালো। কারণ গুটিকয়েক লোক জনগণের নাম ভাঙিয়ে জনগণের অধিকারের কথা বলেছে। কিন্তু এখন তারা প্রতিনিধির বদলে প্রত্যেকে নিজের কথা বলতে চায়, সরাসরি অংশগ্রহণ করে- এ কথা নিগ্রো-ইহুদি, নারী সবার জন্য প্রযোজ্য। নারী বিরাট এক বিদ্রোহের অংশ। নারীরা অনেক সময় বাড়াবাড়ি করে, এটা সত্য, আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি কিছুটা শিখেছি। ভারতে নারী-পুরুষদের মধ্যে কখনো দ্বন্দ্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা ছিল না।
যখনই কোনো নারী নেতৃত্বে এসেছে, হয়তো রাণী হিসেবে জনগণ তাকে গ্রহণ করেছে। এতে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। ভুললে চলবে না যে, ভারতের শক্তির চিহ্ন হচ্ছে নারী। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে নারী ও পুরুষ সমানভাবে। স্বাধীনতার পর কেউ তা ভুলে যায়নি। পাশ্চাত্যে এ ধরনের কিছু ঘটেনি। নারীরা অংশগ্রহণ করেছে সত্য কিন্তু সেখানে বিপ্লব করেছে সব সময় পুরুষরা।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: আমরা এখন ব্যক্তিগত প্রশ্নে আসতে পারি। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে- আপনার মতো একজন নারী কি নিজেকে পুরুষ বা নারীদের মধ্যে স্বচ্ছন্দ বোধ করে?
ইন্দিরা: আমার জন্য এতে কোনো পার্থক্য নেই। আমি প্রত্যেককে একভাবে বিবেচনা করি। আমি দেখি ব্যক্তি হিসেবে- পুরুষ বা নারী হিসেবে নয়। এক্ষেত্রেও তোমাকে দেখতে হবে যে, আমি বিশেষ ধরনের শিক্ষালাভ করেছি। আমি আমার পিতার মতো একজন পুরুষ ও মায়ের মতো একজন নারীর কন্যা। ছেলের মতো আমি বড় হয়েছি। কারণটা ছিল আমাদের বাড়িতে যে শিশুরা আসতো, তাদের অধিকাংশই ছেলে। ছেলেদের সঙ্গে আমি গাছে চড়েছি, দৌড়ের প্রতিযোগিতা করেছি, কুস্তি লড়েছি।
ছেলেদের নিয়ে কোনো জটিলতা বা হীনম্মন্যতা আসেনি আমার মধ্যে। একই সময়ে আমি পুতুল ভালোবাসতাম। অনেক পুতুল ছিল আমার। পুতুলগুলোর কোনো সন্তান ছিল না বললেই চলে। তারা ছিল নারী ও পুরুষ। ব্যারাকে হানা দিতো। কারাগারে আবদ্ধ থাকতো ইত্যাদি। ব্যাপারটা হলো, শুধু আমার বাবা-মা নয়, পুরো পরিবার প্রতিরোধ আন্দোলনে জড়িত ছিল। যখন তখন পুলিশ এসে নির্বিচারে তাদের ধরে নিয়ে যেতো।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: এছাড়া ছিল জোয়ান অব আর্কের গল্প তাই না?
ইন্দিরা: হ্যাঁ, সত্য। জোয়ান অব আর্ক ছিল আমার শৈশবের স্বপ্ন। দশ-বারো বছর বয়সে যখন ফ্রান্সে গেছি, তখন তাকে আবিষ্কার করেছি। আমার মনে পড়ে না, কোথায় তার সম্পর্কে পড়েছি। কিন্তু আমার জন্য সে মুহূর্তে একটি সুনির্দিষ্ট গুরুত্ব সৃষ্টি করেছিল। দেশের জন্য আমি প্রাণ বিসর্জন দিতে চেয়েছি। এটা বোকামির মতো মনে হলেও শৈশবে যা ঘটে আমাদের জীবনে তা চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: বাস্তবিকই তা হয়। আমি বুঝতে চাই, আপনি যে আজকের পর্যায়ে এসেছেন তা কি করে মিসেস গান্ধী?
ইন্দিরা : আমার জীবন ছিল সমস্যাপূর্ণ, কঠোর। শৈশব থেকে আমি দুঃখ ভোগ করেছি। সমস্যার মধ্যে কাটানোটা আমার জন্য মঙ্গলজনক ছিল এবং আমার সমসাময়িক বহু লোককে সমস্যায় কাটাতে হয়েছে। এখনকার নবীনেরা কি সে স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্ন আমাদের জীবনকে গঠন করেছিল। আমার শৈশবের জীবনটা সুখকর ছিল না। আমি শুকনো অসুস্থ এবং ভীতু বালিকা ছিলাম।
পুলিশ যখন পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে যেতো, সপ্তাহের পর সপ্তাহ মাসের পর মাস আমাকে নিঃসঙ্গ থাকতে হতো। শিগগিরই একা থাকতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আট বছর বয়সে আমি ইউরোপে গিয়েছি। একজন বয়স্কের মতো নিজের অর্থের হিসাব-নিকাশ করতাম। লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করে। কে আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে? আপনার পিতা? মহাত্মা গান্ধী?
হ্যাঁ আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা মূলত তাদের দ্বারা প্রভাবিত। সাম্যের চেতনায় তারা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ন্যায়ের প্রতি আমার অনুরাগ এসেছে পিতার নিকট হতে এবং তিনি তা পেয়েছেন মহাত্মা গান্ধীর নিকট হতে। তবে এ কথা বলা ঠিক নয় যে, আমার ওপর পিতার প্রভাব বেশি এবং আমার পক্ষে বলাও সম্ভব নয় যে, আমার ব্যক্তিত্ব গঠনে কার প্রভাব বেশি- মা, বাবা অথবা মহাত্মা গান্ধীর, অথবা যেসব বন্ধুরা আমার সঙ্গে ছিলেন, তাদের।
কারো একার প্রভাব নয়, সবার। কেউ কখনো আমার ওপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি। কেউ আমাকে দীক্ষা দেয়নি। আমি সব সময় স্বাধীনতার মধ্যে কিছু খুঁজতে চেষ্টা করেছি। আমার পিতা সাহসিকতার খুব গুরুত্ব দিতেন এবং ভীতুদের পছন্দ করতেন না। কিন্তু তিনি আমাকে কখনো বলেননি যে, ‘আমি তোমাকে সাহসী দেখতে চাই।’ যখনই কঠিন কাজ করেছি অথবা ছেলেদের সঙ্গে দৌড়ে জয়ী হয়েছি তখন গর্বে মৃদু হাসতেন।
ওরিয়ানা ফ্যালাসি: আপনি নিশ্চয়ই পিতাকে খুব ভালোবাসতেন?
ইন্দিরা: অবশ্যই। আমার পিতা একজন সাধু ব্যক্তি ছিলেন। একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে যে গুণ থাকে তা থেকে তিনি একজন সাধুর কাছাকাছি ছিলেন। তিনি এত ভালো, এত মহৎ ছিলেন। আমি সব সময় তার পক্ষে ছিলাম- শৈশবে এবং এখনো। তিনি কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না- কোনো ব্যাখ্যায়ই না। তার কর্মের মধ্যেই তিনি টিকে থাকবেন- ভারতের ভবিষ্যৎ চিন্তা তাকে আচ্ছা করে রাখতো। আমরা পরস্পরকে বুঝতাম। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস