বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭, ১০:১১:১৮

রোহিঙ্গা তুমি কার!

রোহিঙ্গা তুমি কার!

শিমুল রহমান : বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশী দুর্যোগপূর্ণ সময় পার করছে। ঠিক এই সময়েই বাংলাদেশের সীমান্তে শুরু হয়েছে নতুন সমস্যা সেটি হল ‘রোহিঙ্গা’ সমস্যা। আবারও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর একের পর এক হামলা চালাচ্ছে।

নিরীহ শিশু ও মহিলারা তাদের হামলার শিকার হচ্ছেন। মহিলাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। বারংবার অভিযোগ করা হয় সশস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তবে এই সশস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিমদের নেপথ্যে আসলে কারা কাজ করছে? সেটি সকলের মনেই প্রশ্ন আকারে দেখা দিয়েছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর যে সহিংসতা, অত্যাচার-নির্যাতন চলছে সেটি জাতিগত দাঙ্গা। মিয়ানমার বলছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে,যা তাদের ভুল ধারণা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, বাংলা ভাষাভাষী বহু লোক প্রাচীনকাল থেকেই ওখানে বসবাস করছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এরকম সহিংসতার ঘটনা বারবার ঘটবে, আর বাংলাদেশ সবাইকে আশ্রয় দিবে, এই দায়িত্ব কি বাংলাদেশের পক্ষে নেওয়া সম্ভব।

বিশ্বে প্রায় ২০ লাখ রোহিঙ্গা আছে। যার মধ্যে ৮ লাখ মিয়ানমারে এবং বাংলাদেশে আছে ৫ লাখের বেশি। বাকিরা সৌদি আরব, ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য দেশে বসবাস করে।

জাতিসংঘের তথ্য মতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ও রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী। চৌদ্দশ শতক থেকে প্রায় ৩০০ বছর রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি ২২ হাজার বর্গমাইলের রোহাঙ্গা একটি স্বাধীন ভূখন্ড ছিল। তৎতকালীন বার্মা ও বর্তমানের মায়ানমারের বৌদ্ধ রাজার দখলের মধ্য দিয়ে এটি প্রথম পরাধীন হয়, এরপর ব্রিটিশরা মায়ানমার দখল করলে রোহাঙ্গাও ব্রিটিশ শাসনের অধীন হয়। ব্রিটিশরা মায়ানমার দখল করে একটি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করেছিল কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই তালিকায় রোহিঙ্গাদের নাম উঠানো হয়নি। ১৯৪৮ সালে মায়ানমার বৃটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। এসময়ে মায়ানমারের সংসদে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি ছিল।

কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক শাসক জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখলের পর রোহিঙ্গাদের নাম জাতিগোষ্ঠীর তালিকায় না থাকায় তাদেরকে বিদেশী হিসেবে গণ্য করে নিপীড়ন নির্যাতন চালাতে থাকে। সেই ১৭৮৫ সালে যখন বৌদ্ধ রাজা আরাকান দখল করেছিল তখন যেমন রোহিঙ্গারা পালিয়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল ঠিক একইভাবে সামরিক শাসকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রোহিঙ্গারা বার বার বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি ক্রমশই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা এরই মধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে আরো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারের ফকিরা বাজার, কামুনছি, টাওয়া, ল্যামশি, ওয়ালিদং, আলচাপরে, মেমেতাই, মেমেচোং, ল্যামরি, বনপাড়া, মিরিঞ্জাপাড়া, কোয়াচ্ছং, আচাম্বো, লেনুবাছা, সাকতাকইন্যা পাড়ার অধিবাসী। এ অবস্থায় বিভিন্ন মাধ্যমে মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।

অসমর্থিত একটি সূত্র দাবি করেছে, অনুপ্রবেশের আশায় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩০-৩৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। সহিংসতা থেকে বাঁচতে অনেকে বিভিন্ন পাহাড় ও বনে লুকিয়ে রয়েছে। ফেরত যেতে বাধ্য হওয়ার ভয়ে এরা সরাসরি সীমান্ত অতিক্রমেরও সাহস পাচ্ছে না।

রোহীঙ্গ পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে শক্তিশালী দালাল চক্র। সীমান্তের যে পয়েন্টগুলোয় বিজিবির জোরদার টহল নেই, সেসব এলাকা বেছে নিয়েছে শক্তিশালী দালাল চক্র। এদের অনেকে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দালালদের হাত ধরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। বান্দরবানের আমতলী, ফকিরা বাজার, পুরানমাইজ্যা ও উখিয়ার বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালীসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে অনেকটা অবাধে অনুপ্রবেশ করার কথা রোহিঙ্গা শরণার্থীরাই তথ্য দিয়েছেন।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবিক ও মুসলিম সংগঠন গুলো বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার কথায় বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে আসছে সেটা হল, বাংলাদেশই কি একমাত্র মুসলিম দেশ?

তাদের সাহায্যে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মুসলিম দেশ সৌদি আরব নিজেই কেন এগিয়ে আসছে না? যেসব ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠন যারা নিরাপরাধ মানুষ মেরে নিজেদের খাঁটি মুসলিম হিসাবে প্রমাণ দিতে চায়, তারা কোথায়? তারা গিয়ে ঐসব নির্যাতিত মুসলিম রোহিঙ্গাদের সাথে দাঁড়িয়ে তাদের তথাকথিত জিহাদ করতে পারেনা?

জিহাদ বলতে তো বিধর্মীদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ বোঝায়, বৌদ্ধ বনাম মুসলিম এই হত্যাকাণ্ডে তারা এখানে নাই কেন? জাতিসংঘ কেন এইখানে মানবতার লঙ্ঘন দেখতে পায় না? তারা এটা ভাবছে না ইতিমধ্যেই আমাদের দেশ রোহিঙ্গাদের একটা বিশাল সংখ্যাকে ঠাঁই দিয়ে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। তারপরেও আরো কেন!

শান্তির নোবেলে ভূষিত ‘বড়’ মানুষগণ পৃথিবীর সবখানে মজলুম মানুষের পক্ষে আওয়াজ তুলবেন, এটাই সাধারণ প্রত্যাশা। ভারত থেকে আসা জলে সৃষ্ট সর্বনাশা বন্যায় বাংলাদেশে মানুষ কত কষ্ট পাচ্ছে। ওদিকে মিয়ানমারে নতুন করে শুরু হয়েছে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান। কিন্তু, না ড. মুহম্মদ ইউনূস, না অং সান সু চি, কেউই প্রাসঙ্গিক বিষয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করছেন না। প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট-কোনো দুর্যোগেই এই ‘শান্তি’ পদক প্রাপ্তদের বিপদাপন্ন মানুষ পাশে পায় না। কেন?

এদিকে, সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা ‘আরসা’ গত মার্চ মাসে এক বিবৃতিতে একেবারে খোলাখুলিই জানিয়েছে যে, তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করছে। তাদের ‘আত্মরক্ষা-মূলক’ হামলার মূল টার্গেট হলো মিয়ানমারের ‘নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী।’

আরসার প্রধানের দাবি হচ্ছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব ও সমান মর্যাদা দিতে হবে। ‘আরসা’ তাদের ওই বিবৃতিতে আরও বলেছে যে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত হবে না। তাদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী নয়। বিশ্বের কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের কোনো রকম সম্পর্ক নেই। এমনকি তারা রাখাইনের বিভিন্ন ধর্মের এবং জাতির মানুষকে ও তাদের ধর্মীয় উপাসনার স্থানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের কুটনৈতিক তৎপরতা ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন, বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব- রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোগান বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বনেতারা অন্ধ ও বধির। রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুহারা জনগোষ্ঠী। জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচতেই তাদের এই পলায়ন বলেও মন্তব্য তার।

জাতিসংঘের সোমবারের (২৮ আগস্ট) এক তথ্য বলছে, মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে তিন হাজারের বেশি মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এরমধ্যে অনেকে অবস্থান নিয়েছেন নো ম্যানস ল্যান্ডে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, দুর্ভাগ্যবশত আমাকে বলতে হচ্ছে বিশ্বনেতারা কিছুই করছেন না। তারা এক্ষেত্রে অন্ধ ও বধির। কারণ তারা টের পাওয়ার চেষ্টাই করছেন না কী ঘটছে মিয়ানমারে।

দেখা গেছে, এমন কোন অপরাধ কর্ম নেই যার সাথে রোহিঙ্গারা জড়িত নেই। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই এদের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন না কোন সংবাদ পত্রিকায় উঠে আসছে। এদের নিয়ে আরোও একটি সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই অনুপ্রবেশ আর পুশব্যাক নামক দুটি শব্দের সাথে আমরা পরিচিত হয়ে উঠছি। বিজিবি’র পুশব্যাক আর রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ যেন কার্টুন ছবির ‘টম এন্ড জেরি’। এত কিছুর পরও স্বস্থিতে নেই জেলাবাসী।

উল্লেখ্য, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর একের পর এক হামলা চালাচ্ছে। নিরীহ শিশু ও মহিলারা তাদের হামলার শিকার হচ্ছেন। মহিলাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের এই অমানবিক কার্যক্রমে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে এই নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।-আমাদের সময়
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে