রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০১:১৪:৪৬

এবার হার্ড লাইন, সু চিকে মঙ্গলবার পর্যন্ত শেষ সুযোগের আল্টিমেটাম দিল জাতিসংঘ

এবার হার্ড লাইন, সু চিকে মঙ্গলবার পর্যন্ত শেষ সুযোগের আল্টিমেটাম দিল জাতিসংঘ

নিউজ ডেস্ক : বলা চলে এবার যথেষ্ট হার্ড লাইনে জাতিসংঘ। আর এর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বিবিসির সাক্ষাৎকারভিত্তিক ‘হার্ড টক’ অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা সদস্যের হামলা বন্ধে দেশটির কার্যত নেতা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির রয়েছে আরেকটা সুযোগ।

তিনি আরো বলেন, সু চি এখনই ব্যবস্থা না নিলে ‘ট্র্যাজেডি ভয়ংকর রূপ নেবে’।

মিয়ানমারের চলমান সহিংসতা জাতিগত নির্মূলে রূপ নিতে পারে বলে ইতিপূর্বে হুঁশিয়ার করেছে জাতিসংঘ। তবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত মাসে প্রাণঘাতী জঙ্গি হামলার বদলা নিচ্ছে তারা, বেসামরিক লোকজনকে এর লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে না।

জাতিসংঘে চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগে জাতিসংঘের মহাসচিব বিবিসিকে বলেন, মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেই সেনাদের সাঁড়াশি অভিযান বন্ধে শেষ সুযোগ পাবেন সু চি।

‘তিনি (সু চি) যদি অবস্থার পরিবর্তন না করেন, তাহলে আমি মনে করি এই ট্র্যাজেডি ভয়াবহ রূপ নেবে এবং এর পর নিরাশার সঙ্গে বলতে হবে, আগামী দিনে এই সমস্যা কীভাবে বদলাবে, তার দিশা আমি দেখছি না’, বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবশ্যই নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে দেওয়া উচিত বলে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন গুতেরেজ। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমারে এখনো কলকাঠি নাড়ছে সেনারা এবং রাখাইনে যা চলছে তা চালু রাখতে চাপ দিচ্ছে তারা।

গত ২৪ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে একটি সেনা ও ৩০টি পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা। তাদের সংগঠন রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এই হামলার দায় স্বীকার করে। এর পর থেকে রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয়রা। সেখানে নির্বিচারে খুন করা হচ্ছে নারী, শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে।

সেনা সদস্য ও তাদের দোসরদের এই হামলায় প্রাণভয়ে শনিবার পর্যন্ত চার লাখ ৯ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে ‌এসেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। আর এর ফলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে।

রোহিঙ্গা ইস্যু : পড়ুন আরো খবর:
 

'গুলি করার পর নড়াচড়া করলে গলাকেটে ফেলে'

নিউজ ডেস্ক : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার কারণে লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আব্দুল আজিজ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কাছে নির্যাতনের শিকার হন। সেখানকার পরিস্থিতি এবং নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেছেন তিনি।

সেদিন ছিল বুধবার। বিকেলে আসরের নামাজ পড়তে বের হয়েছি। সেসময় আমাকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

আমার বাড়ি রাখাইনের গারোতো বিলে। বাড়ি থেকে চোখ বেধে নিয়ে যায়, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিছু্‌ই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

চোখ খুললে বুঝতে পারলাম আমাকে একটা 'গ্যারানের টেরায়' যাকে বলা হয় 'গোয়াল ঘরে' নিয়ে রাখা হয়েছে।

দেখলাম ঘরভর্তি মানুষ। আমার মতই তাদেরকেও ধরে নিয়ে আসা হয়েছে।

সেখানে আমাদেরকে নিয়ে গরুর রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে ।

যখন বেঁধে রেখেছিল তখন দুই জন পাহারা দিয়েছে, কারোর বের হওয়ার সুযোগ ছিল না ।

প্রচণ্ড মারধোর করে আমাকে। তারা মিয়ানমারে ভাষায় বলছিলো "লো কালা" অর্থাৎ তোরা আমাদের দেশি না, তোরা বাঙ্গালি, তোরা ওখানেই চলে যা।

আমার সামনে কয়েকজনকে গলাকেটে হত্যা করেছে আবার কাউকে কাউকে গুলি করে মেরেছে।

গুলি মারার পর তখনো যদি সে নড়তে থাকে তাহলে তার গলাকেটে দেয়।

পাহারাদাররা যখন দরজা থেকে সরে গেছে তখন তাদের অবস্থান দেখে আমি পালিয়ে আসি।

আমাকে ধরে নিয়ে গেছিলো আসরের সময় আর আমি পালিয়ে আসি এশার সময় ।

আমি যখন ওইখান থেকে বের হয়ে আসি তখন যাদেরকে তখনো হত্যা করেনি তাদের সবার হাত পা বাঁধা ছিল।

এর পর কি করেছে আমি জানি না । আমি যখন এসেছি তখনো ঐখানে অনেক মানুষ ছিল, শুধু ছিল পুরুষ মুসলিম, কোনো মহিলা ছিল না ।

আমি যখন বাড়ি ফিরে আসি তখন দেখি আমার ঘর আগে যেরকম ছিল সেরকম আর নেই ।

আমার বাড়ি বোমা মেরে জ্বালিয়ে দিয়েছে নাকি ম্যাচের আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে সেটা আমি জানি না, কিন্তু আমার প্রতিবেশীরা বলেছে বোমা মেরে জ্বালিয়ে দিয়েছে।

এর পর থেকে আমার মা-বাবার সাথে দেখা হয়নি, বাংলাদেশে এসেও তাদের খোঁজ পাইনি ।

ওখানে মুসলিমের কোনো দাম নাই, খাবার পানি দেয় না। ভয়ে আতঙ্কে আমার গলা শুকিয়ে আসছিল।

বন্দি অবস্থায় দুই আড়াই ঘণ্টা ছিলাম তখন অন্যদের জিজ্ঞাসা করেছি এখানে কোন খাবার পানি দেয় কিনা, তারা বলেছে কোন খাবার বা পানি দেয় না ।

ঐখানে আমার মতো যুবক যারা ছিল তাদেরকে আগেই ধরে নিয়ে গেছে, তাদেরকে মেরে ফেলেছে, কেটে ফেলেছে। এর পরে ওখানে বেঁধে রাখা কতগুলো আছে ।

ওখানে যুদ্ধ করছে এমন কোনো রোহিঙ্গা আমরা পাইনি । ওখানে যুদ্ধ করার মতো লোক আছে বলে আমার মনে হয় না।

ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে রোহিঙ্গা শিশুটি
বয়স মাত্র নয় বছর। এতো অল্প বয়সেই সহিংসতার বর্বর রূপ দেখেছে সে। পালাতে বাধ্য হয়েছে নিজের দেশ থেকে। তবে একা আসেনি সে, কোলে করে লম্বা পথ বয়ে এনেছে নিজের এক বছর বয়সী ছোট্ট ভাইটিকে।

চোখে-মুখে আতঙ্ক। অঝোর ধারায় কাঁদছে ছোট্ট মেয়েটি।

বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছানোর পরই এই রোহিঙ্গা বালিকার ছোট্ট এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কোনো এক সাংবাদিক। সেটি টুইটারে পোস্ট করেন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক কলামনিস্ট সিজে ভের্লেমান। মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ভিডিওটি।

এতে দেখা যায়, ক্রন্দনরত শিশুটির ঠিকানা এবং বাবা-মায়ের নাম জিজ্ঞাসা করছেন কয়েকজন। এ সময় ছোট ভাই ছিল তার কোলে। তাকে খাবার দিচ্ছিলেন অন্য এক ব্যক্তি।

ভের্লেমান ধারণা করছেন রোহিঙ্গা এই শিশু দুটির মা-বাবাকে সম্ভবত মারা গেছেন। তবে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এদিকে ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে দু'লাখের বেশি শিশু রয়েছে যারা নানা রকম ঝুঁকিতে রয়েছে। এ সব শিশুর মধ্যে অনেকে অপুষ্টির শিকার এবং তাদের ঘুমের সমস্যা রয়েছে বলেও জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের সংস্থাটি।

রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে : জাতিসঙ্ঘ
মিয়ানমারের রাখাইনে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে শরণার্থীর সংখ্যা এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ।

ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বলছে, চলতি সঙ্কটের সবচেয়ে খারাপ দিক হতে পারে এটাই যে, মিয়ানমার থেকে সব রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে চলে আসতে পারে। সংস্থা দুটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো দ্রুততার সাথে সহায়তায় এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার একজন পরিচালক মোহাম্মেদ আবদেকার মোহামুদ ও ইউএনএইচসিআর -এর সহকারি হাই কমিশনার জর্জ অকোথ অব্বুর নেতৃত্বাধীন যৌথ দল সম্প্রতি কক্সবাজারে শরণার্থী পরিস্থিতি দেখে এসেছেন।

বৃহস্পতিবার ওই সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেছেন, শরণার্থী সংখ্যা এখন চার লাখ এবং প্রতিদিন ১০-২০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকছে। নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান নিচ্ছে ১০-২০ হাজার করে রোহিঙ্গা।

তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা সোজা করে বলেছেন, বাংলাদেশ গভীর মানবিক সঙ্কট মোকাবেলা করছে। একই সাথে তারা বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেছেন নিজেদের অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।

তারা বলেছেন, যে রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে তারা দুটো ধারণা করছেন- একটি হল যে পরিস্থিতি ভালো হবে যদি আর কেউ বাংলাদেশে না আসে, কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ বা খারাপ দিক যেটি হতে পারে তা হল এমন অবস্থা চললে সব রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে চলে আসতে পারে।

ইউএনএইচসিআর -এর সহকারী হাই কমিশনার জর্জ অকোথ অব্বুর রীতিমত উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলেছেন, মাত্র আড়াই সপ্তাহে চার লাখ রোহিঙ্গা এসেছে, এটা অনেক বড় একটি সংখ্যা। সে কারণেই এ বিষয়ে এখন অনেক কিছু করনীয় আছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের।

জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বিপর্যয়কর মানবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন।

রাখাইনে চলমান সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং সেখানে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে দেশটির কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ।

এর আগে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ এক জরুরী বৈঠকে বসে। বৈঠকে নিন্দা জানানোর পাশাপাশি সেখানে সেনা অভিযান বন্ধে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বানও জানানো হয়।

কিন্তু তাতে ঠিক কতটুকু সাড়া মিলছে?

জাতিসঙ্ঘের এই কর্মকর্তারা বলেছেন, যে সহায়তা আসছে তা মোটেও যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও দ্রুততার সাথে এগিয়ে আসা উচিত। কাল করবো, পরশু করবো এমন ভাবলে চলবেনা, আজই করতে হবে, আজই এগিয়ে আসতে হবে সহায়তা নিয়ে। এখানকার সরকার ও জনগণ তাদের সাধ্যমত করছে কিন্তু এগিয়ে আসতে হবে বিশ্ব সম্প্রদায়কেই।

এই কর্মকর্তারা বলছেন, হুট করে এতো শরণার্থী বাংলাদেশে চলে আসবে সেটা শুরুতে তারা বুঝতে পারেননি। এখন অনেক কিছুই করতে হবে বলে মনে করেন তারা।

সেজন্য খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয় সুবিধা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। শরণার্থী সংখ্যা তিন লাখ হওয়ার পর জাতিসঙ্ঘ ৭৭ মিলিয়ন ডলারের সহায়তার কথা বলেছিল এখন সেটি চার লাখ পার হওয়ায় এবং আরও বিপুল সংখ্যক শরণার্থী পথে থাকায় কি পরিমাণ সহায়তা লাগতে পারে সেটি নতুন করে নির্ধারণ করা হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।

রোহিঙ্গা নারীদের নির্যাতন, পুরুষদের হত্যা

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী রোহিঙ্গা নারীদের একটা বড় অংশ বর্মী সেনাবাহিনীর হাতে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।

অনেকে নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হয়েছেন বলে পালিয়ে আসা পরিবারগুলো বলছে।

বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে এসব নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন না বলে বলছেন স্থানীয় চিকিৎসকরা।

হাজেরা বেগম উখিয়াতে পালিয়ে এসেছেন তিন দিন হলো। তিনি বলছিলেন, সেনাবাহিনী তাদের বাড়ি ঘেরাও করে।

যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারা প্রাণে বেঁচে গেছেন। আর যারা পালাতে পারেননি তারা হয় নিহত হয়েছে নয়ত তার মতই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

তিনি বলছিলেন, "নির্যাতনের পর আমার মত অনেক নারীই চিকিৎসা নিতে চেয়েছে। বিশেষ করে যাতে করে গর্ভধারণের ঝুঁকি মুক্ত থাকা যায় সেজন্য ওষুধ পর্যন্ত চেয়েছে। কিন্তু পায়নি। আমি নির্যাতনের পরেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু অনেক মেয়ে আছে যাদের নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে।"

বাংলাদেশে ২৫ অগাস্টের পর যত মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তার একটা বড় অংশ নারী এবং শিশু।

তারা বলছেন, পুরুষরা যেমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে তেমনি নারীরা হয়েছে নির্যাতনের শিকার।

আরেকজন নারী তার এক শিশু সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছেন। কিন্তু তার ১৫ বছরের মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছেন।

তিনি বলছিলেন, "আমার মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীর হাতে সে ধরা পড়েছে এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমি এখনো তার কোন খোঁজ পাইনি।"

নারীদের ওপর কী নৃশংসভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মোঃ ইলিয়াস।

তিনি বলছিলেন, তারা যখন পালিয়ে আসেন তখন একজন নারীকে তিনি নির্যাতিত হতে দেখেছেন। কোলে তার শিশু সন্তান ছিল। পরে ওই নারীর অর্ধপোড়া মরদেহ তারা দেখতে পান আরো পাঁচটি মরদেহের সাথে।

এদিকে, কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় যেসব নারী ও শিশু আশ্রয় নিয়েছে তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সরকারের স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎসকরা।

রোহিঙ্গা নারীদের ওপর নির্যাতন সম্পর্কে ডাক্তারের বক্তব্য
তারা বলছেন, নির্যাতনের বিষয়ে নারীরা মুখ খুলছেন না। তাই তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা দেয়ার কাজটা কঠিন হয়ে পড়েছে।

উখিয়ার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, এখন পর্যন্ত তারা ১৮টি ঘটনার কথা জানতে পেরেছেন। তবে তিনি বলছিলেন এই সংখ্যা আরো বেশি।

"গতকাল আমি ছয়জন মায়ের সাথে কথা বলেছি, তাদের কোলে সন্তান ছিল। তারা বলছেন, তারা বার্মার মিলিটারির হাতে 'জুলুমের শিকার' হয়েছে। তাদের চেহারায় বেদনা,কষ্ট, আর আত্ঙ্কের ছাপ রয়েছে।"

মেজবাহ উদ্দিন বলছিলেন, "আমরা মাঠ পর্যায়ের যে তথ্য পাচ্ছি তাতে সংখ্যাটা কম নয়, যেটাতে আমাদের শঙ্কার-আশঙ্কার জায়গা তৈরি হচ্ছে।"

স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন যাতে করে তাদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়।

নির্যাতনের শিকার যেসব নারীদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে তাদের কাউন্সেলিং বা পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, তাদের যদি সনাক্ত না করা যায় তাহলে বড় ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পরতে পারেন তারা।

অনেক শরণার্থী রোহিঙ্গা পরিবারের সাথে পুরুষ সদস্যরা নেই কেন?
সপ্তাহখানেক আগে টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্পে এসেছেন আলমাস খাতুন। ক্যাম্পে এক পরিচিতজনের সাথে আছেন।

আলমাস খাতুন বলছিলেন তার স্বামী এবং একমাত্র ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গেছে। তিনি জানেন না আদেৌ তারা বেঁচে আছেন কিনা।

আলমাস খাতুনের মত অনেক নারী ও শিশু বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা তাদের সাথে আসেনি। তাহলে তাদের পরিণতি কি হয়েছে?

রাখাইন রাজ্য থেকে আসা আরেক জন নারী শরণার্থীর সাথে কথা হচ্ছিল। আমার সাথে কথা বলার সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন।

এই নারী বলছিলেন তার স্বামী এবং তার তিন ছেলেকে তার সামনেই হত্যা করা হয়েছে। দুই ছেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় পিছন থেকে গুলি করা হয়। সেখানেই মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ে।

তিনি আরো বলছিলেন পৃথিবীতে এখন আমার কেউ নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।

গত ২৫ অগাষ্ট হতে এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ ৭০ হাজারের বেশি শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে বলে ধারণা করছে ত্রাণ সংস্থাগুলো। কিন্তু স্থানীয় মানুষ এবং জনপ্রতিনিধিরা বলছে শরণার্থীর সংখ্যা আসলে সাড়ে ৫ লাখের বেশি।

এই বিপুল সংখ্যাক শরণার্থীর বড় অংশই নারী এবং শিশু।

পালিয়ে আসা এসব মানুষ বলছে তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বেশির ক্ষেত্রেই হত্যা করা হয়েছে। অথবা নিখোঁজ আছে।

মোহাদ্দেসা নামে এক নারী বলছেন তার স্বামী, এক ছেলে এবং শ্বশুরকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। তিনি বলছিলেন সেনাবাহিনীর সন্দেহ ছিল তার স্বামী আল ইয়াকিন নামের একটি গ্রুপের সদস্য।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের উপর হামলার কারণ হিসেবে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাকে দায়ি করছে। এই সংগঠনটি স্থানীয় ভাবে হারাকাহ আল ইয়াকিন নামে পরিচিত ছিল।

তবে স্থানীয়ভাবে একটা গুঞ্জন রয়েছে বেশ কিছু পরিবারের পুরুষ সদস্যরা মিয়ানমারে রয়ে গেছেন তাদের ভাষায় লড়াই এ অংশ নেয়ার জন্য। তবে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছেন আবুল কালাম। তিনি অবশ্য এই তথ্যকে নাকচ করে দিলেন।

তিনি বলছিলেন তাকে গুলি করার সময় তারা বলেছে এই দেশ মুসলমানদের জন্য নয়।

'সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন পঙ্গু করে দিচ্ছে' মানুষকে

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে আহত হয়েছে বহু রোহিঙ্গা মুসলিম। পঙ্গু হয়ে যাওয়া কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে বিবিসি।

১৫ বছর বয়সী মিয়ানমারের এক কিশোরের চিকিৎসা চলছে বাংলাদেশের এক হাসপাতালে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে দুটো পা হারিয়েছে এই কিশোর ।

একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরেক নারী, যিনি জানিয়েছেন সীমান্তে গুলি খাওয়ার পর মাইনের ওপর আছড়ে পড়েন তিনি।

নব্বইয়ের দশকে ওই এলাকায় মাইন পুঁতে রাখা হয়েছিল, কিন্তু সম্প্রতি মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর নিষিদ্ধ এ্যান্টি-পার্সোনাল মাইন পুঁতেছে বলে অভিযোগ তুলে বাংলাদেশি বিভিন্ন সূত্র এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

যদিও মিয়ানমারের কর্মকর্তারা এই অভিযোগও অস্বীকার করেছেন।

সম্প্রতি মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসেইন সোমবার বলেছেন, 'মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর-নির্মম অভিযান চলছে'। পাশাপাশি তিনি এটাও বলেছেন যে সেখানে যে হামলা চালানো হচ্ছে তা পাঠ্য বইয়ের জন্য 'জাতিগত নিধন' এর একটি অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা আহত রোহিঙ্গাদের কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে, একটি হাসপাতালে ঘুরের বিবিসির রিতা চক্রবর্তী দেখেছেন বেশিরভাগই সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। অনেকের দেহের নানা জায়গায়, কেউ হাত আবার কেউবা পা হারিয়েছেন।

১৫ বছর বয়সী আজিজু হক, তার দুই পা হারিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন, সাথে আছে তার মা। আজিজুর ভাইও অন্যএক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, তারও একই অবস্থা-জানালেন তাদের মা রুশিদা হক।

"তাদের দেহের ক্ষত এতটাই যে আমার কাছে সেটা মৃত মানুষের মতোই। ওপরওয়ালা যদি তাদের নিয়ে যেত তাহলে ভালো হতো। ছেলেগুলো আমার অনেক কষ্ট করছে" বিবিসিকে বলেন রুশিদা হক।

বিস্ফোরণে আজিজু হকের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে, দুটো পা নেই,এছাড়া শরীরের অন্যান্য জায়গাতেও আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট।

আজিজুকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে ডাক্তাররা। কিন্তু তাকে বাঁচানোর আশা ক্ষীণ বলে জানা যাচ্ছে। কারণ আজিজুরের রক্তের গ্রুপ বিরল, ওই গ্রুপের রক্ত কোনো ব্লাড ব্যাংকে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কদিন রক্তদাতা পাওয়া গেলেও এখন আর কোনো দাতারও সন্ধান মিলছে না।

অন্যদিকে আহত আরেক নারী সাবেকুর নাহার বলেন, মিয়ানমারে তাদের সম্প্রদায়ের লোকজনকে লক্ষ্য করে সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর তিন ছেলেকে নিয়ে নিজ গ্রাম থেকে পালান তিনি। যখন সীমান্ত পার হচ্ছিলেন তখনই গুলির আঘাতে মাইনের ওপর পড়ে যান।

আমাদের গুলি ছুঁড়লো,এবং তারা মাইনও পুঁতে রেখেছিল সেটার ওপর পড়লাম" বলেন ৫০ বছর বয়সী সাবেকুর নাহার।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে