আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অং সান সুচির সমালোচকদের বিরুদ্ধে কড়া বিষোদ্গার করেছেন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার জনসন। তিনি বলেছেন, যারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে অং সান সুচির সমালোচনা করছেন তারা মিয়ানমারের রাজনীতি, এর ইতিহাস কিছুই বোঝেন না। এমনকি তারা বোঝেন না কিভাবে খুব সহজেই মিয়ানমার আবার সামরিক স্বৈরশাসকের কবলে পড়তে পারে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন ক্রিস্টোফার জনসন। তিনি ‘সিয়ামিজ ড্রিমস অ্যান্ড ফ্রিডম রেইনবো’ বইয়ের লেখক। তিনি সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে চায়না স্টাডিজ-এ ফ্রিম্যান চেয়ার এবং সিনিয়র উপদেষ্টা। দুই দশকের মতো তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গোয়েন্দা ও পররাষ্ট্র বিষয়ক শাখায় দায়িত্ব পালন করেছেন। তার রয়েছে বিস্তৃত অভিজ্ঞতা।
এশিয়ার বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিশ্লেষণ করেন তিনি। তিনি চীনের নেতৃত্ব বিষয়ে হোয়াইট হাউসের সিনিয়র, মন্ত্রিপরিষদ, কংগ্রেশনাল, সামরিক, পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তাদের মাঝে মধ্যেই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত লেখায় তিনি বলেছেন, সমালোচনাকারীরা কি মিয়ানমারের রাজনীতি ও জাতিগত সহিংসতার বিষয়ে সুচির থেকেও বেশি বোঝেন? নিজেই তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দেন।
তিনি বলেন, অবশ্যই না। ক্রিস্টোফার বলেন, সমালোচনাকারীদের উচিত একজন নারীর নামে অপপ্রচার বন্ধ করা, যিনি লাখ লাখ সংখ্যালঘুর মতো নিজেও মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের নির্যাতন সহ্য করেছেন। বিশপ ডেসমন্ড টুটু, মালালা ইউসুফজাই, জাস্টিন ট্রুডোসহ অনেকে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান জাতিগত নিধনের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছেন।
এছাড়া ১৯৯১ সালে সুচিকে দেয়া নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন ৪ লাখেরও বেশি মানুষ। সুচিকে দেয়া কানাডার সম্মাননামূলক নাগরিকত্ব বাতিল করার জন্য আবেদন করেছে ২০ হাজার মানুষ। কিন্তু বিদেশিদের আহ্বানে সাড়া দেয়ার পরিবর্তে সুচি তার নির্বাচনী এলাকার লোকদের পক্ষ নিয়েছেন, যারা অনলাইনে এমন সব ভিডিও-ও প্রকাশ করেছে যাতে দেখানো হয়েছে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা বৌদ্ধদের জমি ও সম্পদ লুণ্ঠন করছে, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শিরশ্ছেদ করছে, মেয়েদেরকে সম্ভ্রমহানী করছে ও সব জায়গায় তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের সূত্রপাত করছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অং সান সুচি বলেন, সরকার রাখাইন প্রদেশের লোকদের রক্ষা করতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এ সময় তিনি গত মাসে পুলিশ হত্যা ও সীমান্ত রক্ষী কর্মকর্তাকে হত্যার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে দোষারোপ করেন। এরা ভুল তথ্য ছড়িয়ে সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করছে বলেও মন্তব্য করেন সুচি।
ক্রিস্টোফার লিখেছেন, সুচি সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং-এর সঙ্গে কাজ করছেন, যিনি রাখাইনে বাঙালি সন্ত্রাসীদেরকে (রোহিঙ্গাদেরকে) পুনরায় ১৯৪০ সালের মতো সহিংসতা সৃষ্টি করার সুযোগ দিতে চান না। যদিও তুরস্কের রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এরদোগান যে ক্ষমতা ভোগ করেন, তা সুচির নেই। আবার সুচির হাতে কানাডার জাস্টিন ট্রুডোর মতোও কোনো ক্ষমতা নেই, যিনি কিউবার প্রয়াত বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর প্রশংসা করেছেন।
অং সান সুচি ১৯৯০ ও ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী বৃটিশ নাগরিককে বিয়ে করার কারণে সুচি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। এ সংবিধান তিনি সংশোধনও করতে পারবেন না। কেননা, সেনাবাহিনী পার্লামেন্টে কার্যত ভেটো দিয়ে রেখেছে। এছাড়া, সেনাবাহিনী, পুলিশ, সীমান্ত ও আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে। এ অবস্থায় সুচির পক্ষ নিয়েছেন ইয়াঙ্গুনের আর্চবিশপ কার্ডিনাল চার্লস মং বো।
তিনি বলেছেন, সুচি একটি টাঙ্গানো রশির ওপর দিয়ে হাঁটছেন। আর অপশক্তিরা সেনা শাসন ফিরিয়ে আনতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, অং সান সুচিকে দোষারোপ করা ও তাকে মিডিয়ার দ্বারা আক্রমণ করা কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান না। একটি ভুল পদক্ষেপ তাকে সরকারের বাইরে ছিটকে দিতে পারে, যা হবে একটি গণতন্ত্রের স্বপ্ন নিঃশেষের কারণ।
সব সময় মনে রাখতে হবে যে, মিয়ানমারের ইতিহাসে সেনাবাহিনী তিনবার গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে নিয়েছে (উৎখাত করেছে)। আর রাখাইন সংকটে সুচি সবচেয়ে খারাপ খেলোয়াড় না। এদিকে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদেরকে জলদস্যুদের জন্য কুখ্যাত বন্যাপ্রবণ একটি দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি মুসলিম অধিবাসীর দেশ ইন্দোনেশিয়াও ৪ লাখ রোহিঙ্গা নিতে চায় না। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সম্ভ্রমহানী, হত্যা ও নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে (রোহিঙ্গা) যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয় নি।
অন্যদিকে মিয়ানমারকে শাস্তি দেয়ার জন্য এশিয়ার ইসলামী মৌলবাদী দলগুলোর প্রতি জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদার আহ্বান ইসলামী উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বীকৃত নারীবাদী ট্রুডো সুচির সমালোচনা করলেও মিয়ানমারের ইসলামী উগ্রপন্থিদেরকে দোষারোপ করেননি। তিনি কানাডিয়ান খনি ব্যবসায়ীদেরকে মিয়ানমারের দুর্নীতিগ্রস্ত জেনারেলদের সঙ্গে ব্যবসা করতেও নিষেধ করেননি। মিয়ানমারের অনেকে এসব বিদেশিদের মধ্যে কপটতা খুঁজে পেয়েছেন।
নব্বইয়ের দশকে এসব সমালোচকরাই সুন্দরী তরুণী অং সান সুচিকে গণতন্ত্রের দূত বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তখন এ নির্যাতিত বৌদ্ধ তরুণীর প্রশংসা করা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল। অথচ যখন মিডিয়া মুসলমানদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত বলে চিত্রায়িত করছে, তারা ৭২ বছর বয়সী এ মা’কে অবজ্ঞা করছে। কয়েক দশকের যুদ্ধের পর সুচি রাতারাতি মিয়ানমারকে একটি অন্য রূপ দিতে পারেন না, যেমনটি করেছেন ট্রুডো।
যেখানে সবাই খুশি। বর্তমানে মিয়ানমার ওবামা যুগের আত্মপরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। মিয়ানমারের লাখ লাখ মানুষ ভালো রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল, বিদ্যুৎ, পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে ভুগছে। এ অবস্থায় যখন সুচিকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলো, তিনি সবার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য মানবাধিকার কর্মীরা সামরিক জান্তাদের চেয়ে সুচির সঙ্গেই বেশি যোগাযোগ করেন। এশিয়ার সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ মহিলাকে দোষারোপ না করেও রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব। নীরব বা সহানুভূতিশীল যাই হোক না কেন, এখনো সুচিই সেরা বিকল্প। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস