বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৩:১৯:৫২

সু চি’র ভাষণ নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করা বিবিসির সাংবাদিকের বক্তব্য

সু চি’র ভাষণ নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করা বিবিসির সাংবাদিকের বক্তব্য

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি শেষ পর্যন্ত কথা বলেছেন রাখাইনের সহিংসতা ও শরণার্থী সংকট নিয়ে। কিন্তু ভাষণে তিনি যেসব দাবি করেছেন তা কতটা সঠিক না বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসি সংবাদদাতা জোনাথন হেড, যিনি মিয়ানমার ও বাংলাদেশে সরেজমিন পরিস্থিতি দেখেছেন।

অং সান সু চি বলেছেন, "৫ই সেপ্টেম্বরের পর থেকে সেখানে (রাখাইনে) কোন সহিংসতা নেই"।

জোনাথন হেড: ৭ই সেপ্টেম্বর সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি মিডিয়া দলের অংশ হিসেবে আলেল থান খিয়াও শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে অটোমেটিক রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো এবং বড় ধরনের চারটি ধোঁয়ার লাইন দেখতে পাচ্ছিলাম যা নিশ্চিত ইঙ্গিত দিচ্ছিলো যে গ্রামগুলো আগুনে পুড়ছে। ওইদিনেই পরের দিকে আমরা যাই রোহিঙ্গা গ্রাম গাউ দু থার ইয়া যেখানে সশস্ত্র পুলিশের সামনেই বৌদ্ধদের লাগানো আগুন তখনো জ্বলছিল। পরে বাংলাদেশ থেকেও আমি নাফ নদীর ওপারে আগুনের ধোয়া স্পষ্টই দেখতে পাই।

অং সান সু চি: ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন আইনের বাইরে গেলে বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে যে কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জোনাথন হেড: বার্মার সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কিন্তু কখনোই কোন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মংগদুতে একজন সেনা কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন যে নির্যাতনের অভিযোগগুলো সত্যি নয় কারণ তার সৈনিকরা ব্যস্ত আর রোহিঙ্গা নারীরা আকর্ষণীয় নয়।

অং সান সু চি: রাখাইনে সব মানুষের কোনো বৈষম্য ছাড়াই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অধিকার রয়েছে।

জোনাথন হেড: এটা নির্জলা মিথ্যা। রোহিঙ্গারা বহু বছর ধরেই বৈষম্যের শিকার। এমনকি তাদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত। বিয়ে করতেও অনুমতি নিতে হয়, আবার সে অনুমতির জন্য ঘুষও দিতে হয়। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর থেকে তাদের ওপর বিধিনিষেধ আরও জোরদার করা হয়। অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে মিয়ানমারের মধ্যেই ক্যাম্পে অবস্থান করে। আমি জানি ক্যাম্পের শিশুগুলো পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো পাঁচ বছরের জন্য। চার বছর আগে আমি একটি রোহিঙ্গা গ্রামে গিয়েছিলাম বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সহিংস আচরণের জন্য রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা নিতে যাওয়াও অসম্ভব ছিলো।

জোনাথন হেড বলেন, গত সোমবারই বাংলাদেশে তার সাথে দেখা হয় মোহাম্মদ আব্দুল মজিদের। সে এসেছে গাউ দু থার ইয়া গ্রাম থেকে যেটিকে তিনি পুড়তে দেখেছেন ৭ই সেপ্টেম্বর।

আব্দুল মজিদ তাকে জানান যে গত পাঁচ বছর তারা কাজের জন্য গ্রামের বাইরে যেতে পারেননি।

অং সান সু চি'র ভাষণে সেনাবাহিনীর বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি

মিয়ানমারে নেত্রী অং সান সু চি রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন তা প্রত্যাখ্যান করেছেন রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠন ও নেতারা।

তারা বলছেন, সূ চি সব জেনেও না জানার ভান করেছেন এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মনে করে, এই ভাষণে সেনাবাহিনীর বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা গত তিন সপ্তাহে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এখনো প্রতিদিন আরো ১০ থেকে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে।

রোহিঙ্গারা বলছে, নির্যাতনের কারণেই তারা তাদের নিজের গ্রাম ও ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন এবং মিজ সু চি সেটি ভালো করেই জানেন।

তারপরেও কেন এতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, সে সম্পর্কে জানা নেই বলে সু চির যে বক্তব্য সেটা ক্ষুব্ধ করেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে।

রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন - আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম লন্ডনে থেকে সংগঠনটির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তিনি বলেছেন, রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে অং সান সু চি পুরোপুরি অসত্য বক্তব্য তুলে ধরেছেন।

তিনি বলেন, ‘সু চি তার বক্তব্যে যা বলেছেন তা মোটেও সঠিক নয়। তার না জানার মতো কোন কারণ নেই। সময়ে সময়ে রোহিঙ্গারা তাকে সব জানিয়েছে- কি হচ্ছে আর না হচ্ছে। আর সু চি জেনেও না জানার মতো করছেন। শি ইজ অ্যা প্রিটেন্ডার। একই সময়ে তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। আমরা তো খালি হয়ে গেছি সেটা আপনারা দেখছেন তো। ওখানে আছে কি এখন? মানুষ তো একদমই নাই হয়ে গেছে সেখানে। আমার মন্তব্য হলো উনি ভনিতা করছেন ও মিথ্যা কথা বলছেন। জেনেও না জানার মতো আচরণ করছেন।’

বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা মূলত অবস্থান করছেন কক্সবাজার জেলার শরণার্থী শিবিরগুলোতে। এই দফাতে নতুন করে আসা শরণার্থীদেরও একটি বড় অংশকে এসব শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

এমনই একটি কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গাদের একজন নেতা মোহাম্মদ নূর বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কারণেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু সু চি এই সত্যকে গোপন করেছেন।

‘সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছেন সু চি। অত্যাচার না করলে, নির্যাতন না করলে, গুলি না করলে, কাটাছেঁড়া না করলে মানুষ কেন আসবে এখানে। জীবনেও আসতো না। মিয়ানমারে মুসলিম ছিলো ১২ লাখ। এর মধ্যে সাত লাখই তো এখানে এসে পড়েছে। মানুষ শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকতে পারলে কি একদেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে আসে? সূ চি সামরিক বাহিনীর লোকজনকে ভয় পান। সেজন্যই এভাবে বলেছেন,’ বলেন তিনি।

সু চি তার ভাষণে কী বলবেন তা নিয়ে অনেক আগ্রহ ছিলো রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠনের। কিন্তু তার ভাষণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই তৈরি করেছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে।

অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক রোহিঙ্গা ইন্টেলেকচুয়াল কমিউনিটির প্রেসিডেন্ট ড: লা মিন্ট বলেছেন, অং সান সূ চি-র বক্তব্য আর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বক্তব্যকে তারা আলাদা করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, ‘উনার বক্তব্য আর সেনাবাহিনীর বক্তব্যের সাথে কোনো পার্থক্য নেই। একই কথা বলেন উনারা। এটা সেনাবাহিনীরই বক্তব্য। উনি যা বলেছেন তার বক্তব্যের ৯০ ভাগই মিথ্যা কথা। রোহিঙ্গাদের নিয়ে তিনি যা বলেছেন সবাই আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি।’
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে