আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গত ২৪ আগস্ট দিনগত রাতে রাখাইনে যখন পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এর জেরে ‘অভিযানের’ নামে নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। পরবর্তীতে এই হামলার দায় স্বীকার করে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি ‘আরসা’।
ফরাসি বার্তা সংস্থা ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর ডট কম গতকাল কথিতমতে আরসার নেতা হিসেবে একজন রোহিঙ্গা ‘গেরিলা কমান্ডারের’ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। তথাকথিত ওই এরিয়া লোকাল কমান্ডারের বরাতে প্রচার করা হয়েছে, তারা প্রতিদিন ৩শ’ রোহিঙ্গাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আর এতে মনে হচ্ছে একটা সময়ে কঠিন যুদ্ধ হবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে।
এরিয়া লোকাল কমান্ডার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া আরমান নামের ওই কমান্ডারকে ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর-এর সম্প্রচার করা ভিডিও ফুটেজে মরচেপড়া একটি টিনের ঘরে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়।
ওই ভিডিও ফুটেজে আরসার কমান্ডারের বরাতে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি দাবি করেছেন, ২০১২ সালে বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষ একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষার জন্য তরুণ ছাত্র ও কৃষকরা এতে অংশ নেয়।
সংস্থাটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি আরসার বিরুদ্ধে কট্টরপন্থি ইসলামী জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।
এভাবে দায়ী করার প্রেক্ষাপটে আরমেন নামের এই আরসা নেতা দাবি করেছেন যে, ‘আগস্টের শেষদিকে আরসার পতাকাভুক্ত বিদ্রোহীরা বর্মী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে সমন্বিত বিধ্বংসী হামলা চালিয়েছে।’ তার কথায়, ‘আমরা সন্ত্রাসী নই, আমরা আইএস (ইসলামিক স্টেট)-এর কেউ নই এবং আমরা কোনো বাংলাদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের কেউ নই।’
এই কথিত আরসা কমান্ডার আরো উল্লেখ করেছেন, আমরা আল-কায়েদার কাছ থেকে কোনো সাহায্য চাই না। আমরা সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে অনুদান চাই।
ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর-এর প্রকাশ করা একটি অডিও ভিজ্যুয়ালে টেপে সাংবাদিক সোনা ভট্টাচার্যের কাছে নিউজকাস্টারের প্রশ্ন ছিল, আপনাদের সঙ্গে কিভাবে এই আরসা গেরিলা নেতার সাক্ষাৎ ঘটেছে?
ভট্টাচার্য উত্তর দিয়েছেন, মাইসা একজন আরবিভাষী সাংবাদিক। এই প্রথমবারেরমতো আরসার কোনো গেরিলা কমান্ডার কোনো টিভি ক্রুর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন এটা তার জন্য ভয়ঙ্কর। এবং আমরা যারা সাক্ষাৎকার নিয়েছি তাদের জন্যও ভয়ঙ্কর। সে কারণে এই বিদ্রোহীদের সম্বন্ধে আমাদের পক্ষে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
এরপর তাকে প্রশ্ন করা হয়, এই সংগঠনের কত সদস্য রয়েছে এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে তাদের প্রতি সমর্থন কি রকম?
উত্তরে সোনা ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘আমাদের সূত্রগুলোর মতে প্রতিদিন তিন শ’ রোহিঙ্গাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে গোপন প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যেখানে আমাদের পক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। গত আগস্ট থেকে এই পর্যন্ত একহাজার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। অনেক রোহিঙ্গার মধ্যে তাদের প্রতি যেমন সমর্থন রয়েছে। কারণ তারা তাদের পক্ষে তাদের অধিকার আদায়ে লড়াই করছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদেরকে দোষীও করে থাকেন।
এই রোহিঙ্গারা যুক্তি দিচ্ছেন যে, গত ২৫শে আগস্টে আরসা যদি নিরাপত্তা বাহিনীর ফাঁড়ি ও চৌকিগুলোতে হামলা না চালাতো তাহলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে এই নির্যাতন চালাতো না।’
তিনি আরো বলেন, ‘তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। চুরি করা কিছু বন্দুকও তাদের হাতে আছে। কিন্তু বন্দুকের গোলাবারুদ নেই। সুতরাং তাদের ‘মিনস’ একেবারেই সীমিত।’
এর আগে হংকংভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা এশিয়া টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (আরসা)-কে জিহাদি নয়, বরং জাতিগত মুক্তিকামী সংগঠন বলে দাবি করেছেন সংগঠনের এক মুখপাত্র। তিনি বলেন, মিয়ানমারের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করাই তাদের উদ্দেশ্য।
ওই মুখপাত্র বলেন, গত ২৫ আগস্টের হামলা ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরে পাওয়া পর্যন্ত এ লড়াই চলবে।
গত ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিক্রিয়া থেকেই আরসা’র জন্ম বলে জানান সংগঠনের প্রধান নেতার মুখপাত্র আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, আরসা ধর্মভিত্তিক নয়, জাতিগত অধিকারভিত্তিক সংগঠন।
আবদুল্লাহ বারবারই জোর দিয়ে বলেন, ‘আরসা’র লড়াই জাতীয়তাবাদী, আমরা জিহাদি নই। আরসা’র কর্মপদ্ধতি, কাজের ধরন, যেভাবে তারা সংগঠন চালায় এবং যে লক্ষ্যের দিকে তারা চলছে, তাতেও এটা স্পষ্ট। এর কোনোটাই পাকিস্তানি কিংবা অন্য কোনো জিহাদি গোষ্ঠীর লক্ষ্যের সঙ্গে মেলে না। আমরা আসলে মিয়ানমারের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোরই মতো।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তার আহ্বান, আরসা-কে ‘সন্ত্রাসবাদী ভাবা কিংবা মিয়ানমার সরকারের ফাঁদে পড়া’ থেকে সতর্ক থাকুন।
আরসা’র এই মুখপাত্র বলেন, ‘মিয়ানমারের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের অবস্থান পুনর্বহাল করতে হবে। যতদিন আমাদের দাবি মানা না হবে, তত দিন প্রতিরোধ চলবে।’
যদি এ দাবি না মানা হয়, তাহলে সংগ্রাম ‘অন্য স্তরে’ নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তবে ‘অন্য স্তরে বলতে স্বাধীনতা’ বুঝিয়েছেন কিনা তা স্পষ্ট করেননি আবদুল্লাহ।
মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে আরসা-কে ‘বাঙালি সন্ত্রাসবাদী’ বলে অভিযোগ করে আসছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ঢাকায় মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে ডেকে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস