শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৭, ০৯:৪৭:৫৩

আটলান্টিক মহাসাগরে ২১৬ জন যাত্রী নিয়ে নিখোজ হয়ে গেলো বিমান তারপর...

আটলান্টিক মহাসাগরে ২১৬ জন যাত্রী নিয়ে নিখোজ হয়ে গেলো বিমান তারপর...

প্যারিসের উদ্দেশে ফ্লাই করে
২০০৯ সালের ৩১ মে এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইট ৪৪৭ রিও ডি জেনেরিও থেকে ২১৬ জন প্যাসেঞ্জার নিয়ে প্যারিসের উদ্দেশে ফ্লাই করে। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর কোথাও সেটি নিখোঁজ হয়ে যায়। বিমানের সব আরোহী প্রাণ হারান।তারপর শুরু হয় বিমানযাত্রার ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যজনক দুর্ঘটনার কারণ জানার জন্য বিমানের ব্ল্যাক বক্স উদ্ধারে অলিভার ফেরান্তের নেতৃত্বে সাগরতলে তদন্তকারী দলের দুই বছর মেয়াদি অভিযাত্রা। রিডার্স ডাইজেস্ট অবলম্বনে লিখেছেন এরশাদ আলী

সেদিন ছিল সোমবার। রৌদ্রোজ্জ্বল ছুটির দিন। অলিভার ফেরান্তে প্যারিসের উত্তরে তার বাগানে শিকে মাংসের কিমা রান্না ও বন্ধুদের আপ্যায়ন করছিলেন। ফোন বেজে উঠল। কল ফরাসি বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো বিইএ থেকে। ৩৮ বছর বয়সী সাবেক রাগবি প্লেয়ার ও ডাইভার অলিভার সেখানকার একজন তদন্তকারী। খবরটি ছিল ভয়ানক। আটলান্টিকের ওপর একটি এয়ারবাস নিখোঁজ হয়েছে। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন।

ফেরান্তে অতিথিদের বিদায় জানালেন। স্ত্রী ও ছোট্ট মেয়ে দুটোকে চুমু খেলেন। তারপর দ্রুত লা বোর্গে বিমানবন্দরের একেবারে কিনারায় অবস্থিত অফিসের উদ্দেশে রওনা হলেন। একজন নিরাপত্তা তদন্তকারী হিসেবে অলিভার ফেরান্তে ও তার টিম এর আগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লোহিত সাগর, কৃষ্ণ সাগর, জাভা সাগর এবং প্রত্যেক মহাসাগরে দুর্ঘটনায় ধ্বংস হওয়া প্লেন উদ্ধারে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এবারের তদন্ত ছিল খুবই কঠিন। বিমানটি কোনো বিপদ সঙ্কেত না দিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কোনো সাক্ষী ছিল না। রাডারেও কোনো সঙ্কেত ছিল না।

নিখোঁজ হওয়ার আগে এয়ারবাসটি ব্রাজিল ও পশ্চিম আফ্রিকার মাঝামাঝি জায়গায় সবশেষ যে অবস্থানে ছিল বলে জানা গেছিল সেখানে কমপক্ষে আটটি জাহাজ ও এক ডজন সামরিক বিমান জড়ো হলো। তারপর ঢেউয়ের ওপর জীবনের চিহ্ন অথবা ধ্বংসাবশেষের সন্ধান শুরু করল। ছয় দিন পর সমুদ্রে হতভাগ্য বিমানের ডানা ও ৫০টি লাশ শনাক্ত করা গেল এবং প্রথম জরুরি প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল। ধ্বংসাবশেষে চাপ ও ভাঙার লক্ষণ আর যাত্রীদের ক্ষত দেখে বোঝা গেল দুর্ঘটনাকবলিত এয়ারবাসটি পানিতে আঘাত করা পর্যন্ত অক্ষত ছিল। সেটা বোমায় কিংবা বজ্রপাতে বিস্ফোরিত হয়নি। অথবা উড্ডয়নের শেষ মুহূর্তগুলোতে খারাপ আবহাওয়ার কবলেও পড়েনি। সবচেয়ে রহস্যজনক ব্যাপার ছিল যে, পাইলটরা কোনো মে ডে (উদ্ধারের আন্তর্জাতিক সঙ্কেত) পাঠাননি।

এএফ ৪৪৭ : লাপাত্তা
রাত ১০.২৯ ইউটিসি, রোববার ৩১ মে, ২০০৯

দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট চওড়া বডির এয়ারবাস রিও ডি জেনেরিও থেকে উড়াল দিলো। ক্যাপ্টেন মার্ক ডুবিয়াস (৫৮) প্যারিসের দিকে যাত্রা করলেন। ১০ ঘণ্টার এ যাত্রায় ৩২ দেশের ২১৬ যাত্রীর মধ্যে ছিলেন হানিমুনে গমনকারী, ব্যবসায়ী, অধ্যাপক, মিউজিশিয়ান এবং আটটি শিশু। ঘণ্টা দ্ইু পর তৃতীয় পাইলট পিয়েরে সেডরিক বনিন (৩২) বিমানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। ফ্লাইটে তার স্ত্রীও ছিলেন প্যাসেঞ্জার হিসেবে।

রাত ১.৩৩, সোমবার, ১ জুন
ক্যাপ্টেন বিশ্রামে থাকায় দ্বিতীয় পাইলট ডেভিড রবার্ট (৩৭) ব্রাজিলের রেসিফের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে শেষ রেডিও যোগাযোগ করেন। ডিনার সার্ভ করার পর ৯ জন কেবিন ক্রু রিলাক্স করছিলেন।

রাত ২.১০
স্যাটেলাইটে এয়ারবাসের অবস্থান ধরা পড়েছিল ব্রাজিল উপকূল থেকে ১০০০ কিলোমিটার দূরে এন২.৯৮ ডব্লিউ৩০.৫৯। ৫ সেকেন্ড পরই এয়ার ফ্রান্সের হেড কোয়ার্টারে বিমানের গতি এবং থ্রাস্টে সমস্যা হচ্ছে বলে ঝড়োগতির অটোমেটিক টেক্সট মেসেজ গেল।

সকাল ৯.১০
এএফ ৪৪৭ ফ্লাইটের প্যারিসে ল্যান্ড করার কথা। কিন্তু বিমান এলো না।

বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরোর পরিচালক পল লুইস আরসালানিয়ান আমেরিকান, ব্রিটিশ ও অন্যান্য তদন্তকারীর সহায়তায় এক ব্যাপক তদন্তকাজ শুরু করলেন। প্রধান তদন্তকারী করা হলো অ্যালেন বোলার্ডকে এবং পানির নিচে উদ্ধারকাজ চালাতে ফেরান্তের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ গঠন করা হলো। তবে আটলান্টিকের তলদেশের কোথাও পড়ে থাকা এয়ারবাসের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে ফেরান্তের সফলতার ওপর নির্ভর করছিল সব কিছু। তার টিম কাজও করছিল একবারে উন্মত্তভাবে। পৃথিবীর যেখানে যে সাহায্য পাওয়া যাচ্ছিল তা নেয়া হলো। ফ্রান্স ও অন্য দেশের নৌ মন্ত্রণালয় ও গবেষণা সংস্থার সাথে পরামর্শ করা হলো। উপযুক্ত জাহাজ ও হাইটেক যন্ত্রপাতির সহায়তা নেয়া হলো। ফেরান্তে আরো ২৯ দিন বাড়ি ফিরতে পারলেন না।

প্রথম অগ্রাধিকার ছিল বিমানের ডুবে থাকা স্থান নির্দেশক বেকন থেকে আলোর সঙ্কেত অথবা তীক্ষ শব্দ পাওয়া। স্থান নির্দেশকের ব্যাটারি ৪০ দিন পরও কার্যকর থাকে। দুর্ঘটনার নয় দিন পর ফরাসি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন এমেরুদে এয়ারবাসের ধ্বংসাবশেষ যে এলাকায় ছিল সেটা খুঁজে পেল বলে মনে হলো। সাবমেরিনের ছোনার (প্রতিফলিত শব্দতরঙ্গের সাহায্যে পানিতে নিমজ্জিত বস্তুর অবস্থান নির্ণয়ের যন্ত্র) যখন ক্ষীণ একটি আওয়াজ শনাক্ত করল আশা জেগে উঠল। কিন্তু শিগগির আশা মিলিয়ে গেল। কারণ সে আওয়াজ তিমির ডাক বলে পরে শনাক্ত হলো। পরের আশা ছিল দুটো ডাচ টাগ বোট নিয়ে। সমুদ্রের ৬ হাজার মিটার নিচের আওয়াজ শনাক্ত করার ক্ষমতা ছিল সেগুলোর।

কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। শব্দ পাওয়ার মাধ্যমে অনুসন্ধানের ইতি ঘটানো হলো। কোনো সঙ্কেত শোনা গেল না এবং কোনো ধ্বংসাবশেষও মিলল না। ফরাসি গবেষণা জাহাজ পোরকুই পাস দুর্ঘটনা এলাকা জরিপ করে বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করল। আর ফেরান্তের উজ্জ্বল আশাবাদ ত্রুটিপূর্ণ অনুমিত হলো।

বিমানটি যে এলাকায় নিশ্চিতভাবেই রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল তার আকার তাইওয়ানের আয়তনের সমান এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যও একই রকম। মধ্য আটলান্টিক রিজের মাঝখানের ওই এলাকা সমুদ্র তলদেশ থেকে তিন হাজার মিটারের চেয়ে বেশি উচ্চতাবিশিষ্ট পর্বতে ভরা। সেখানকার একটি খাড়া পাহাড় দুনিয়ার সমস্ত পানির নিচের পর্বতের মধ্যে সর্বোচ্চ। সর্বোপরি চার হাজার মিটার নিচে পানির চাপ ৪১৬ বার। একটি কয়েনের ওপর একখানা ভ্যানের চাপের সমান। তাপমাত্রা ফ্রিজিং পয়েন্টের কিছু ওপরে এবং পানির রঙ পিচের মতো কালো। এসব কারণে ফেরান্তে বাইরে কাজ করা সহজ হবে বলে মত প্রকাশ করলেন। টিমকে তিনি বললেন, শব্দসঙ্কেত ছাড়াই আমাদের কাজটি করতে হবে। তবে তা হবে কঠিন।

২০১০ সালের ২ এপ্রিল। এয়ারবাস নিখোঁজের ১০ মাস পর মধ্য আটলান্টিক থেকে ফেরান্তে সঙ্কেত পেলেন। নরওয়ের সহায়ক জাহাজ সিবেড ওয়ার্কারের ডেক থেকে একটি মিনি সাবমেরিন আটলান্টিকে নামানো হয়েছিল। শেষমেশ তিনি যে অনুসন্ধান সমন্বয় করছিলেন সেটা শুরু হলো। এ কাজের কন্ট্রাক্ট যে সাবমেরিনকে দেয়া হলো সেটা ছিল একটি অটোনোমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল (এইউভি)। সমুদ্রতল জরিপ এবং মাইন কিংবা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খোঁজার জন্য উডস হোল ওসেনোগ্রাফিক ইন্সটিটিউশন এবং ইউএস নেভি সেটা তৈরি করেছিল।

প্রায় চার মিটার লম্বা উজ্জ্বল হলুদ রঙের এ যন্ত্রটি ধীরগতিতে নড়াচড়া করে। তবে সব পাশের ছোনার ছবি সেটা তুলতে পারে। তিনটি এইউভি ২৪ ঘণ্টা ধরে তৎপর থাকল। প্রতিটি দৈনিক ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা অনুসন্ধান করতে থাকল। মাঝে মধ্যে পানির নিচের টিলা কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল। এ ছাড়া কখনো কখনো সাবমেরিন কোনো গিরিখাতে ঢুকে পড়লে আবার ফেরত আনতে হতো। দিনের পর দিন পর্দা ফাঁকা থেকে গেল। মাঝে মধ্যে যা পাওয়া যাচ্ছিল সেগুলো বোল্ডার বা জাহাজের বর্জ্য। ডিভাইসগুলো পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত মাইক পারসেল বললেন, এটা বেশ দীর্ঘমেয়াদি কাজ হবে।

সারা দুনিয়ার মহাসাগর বিশেষজ্ঞদের ডাকা হলো, সাগরের ওপরে ভাসমান জাহাজের ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিমানটির আঘাতের স্থান নির্দিষ্ট করার উদ্দেশে। ফেরান্তের আশা ছিল এটা অনুসন্ধান এলাকার আকার ছোট করতে সাহায্য করবে। কিন্তু দু’তিন সপ্তাহের পরিশ্রম বৃথা গেল। সাগরের স্রোত সম্পর্কে ভালো ধারণা পেতে ফরাসি নৌবাহিনীর একটি বিমান থেকে যে জায়গায় প্রকৃত ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল সেখানে নয়টি ভাসমান বয়া ফেলা হলো। উপগ্রহের মাধ্যমে সেগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হলো। বিষুবরেখার নিকটবর্তী ওই এলাকার উত্তাল স্রোতে সেগুলো সব দিকে যাতায়াত করে প্রমাণ করল পৃথিবীর ওই অংশে স্রোতধারা পর্যবেক্ষণে প্রচলিত ধারা আদর্শ নয়।

মিডিয়ার আগ্রহের চাপে এবং নিহতদের আত্মীয়স্বজনদের সাথে বেদনাঘন সাক্ষাতে ভারাক্রান্ত ফেরান্তে মাথা হালকা করতে এক দিন জগিংয়ে বেরোলেন। সেখানে তার মাথায় নতুন আইডিয়া ঢুকল। তিনি এর আগে এ রকম উঁচু দিয়ে উড্ডয়নের সময় যে নয়টি বিমান আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল সেগুলোতে কী কী সমস্যা ধরা

পড়েছিল তা দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি দেখলেন, সেগুলোর কোনোটাই সাগরে আঘাত করার আগে ৩০ কিলোমিটারের বেশি পেরুতে পারেনি। বেশির ভাগগুলো তার অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করেছিল। এইউভি অপারেশন ২০১১ সালের ২৫ মার্চ আবার শুরু হলো। তবে এবার বিমানটির জানা সবশেষ অবস্থানের ৩০ কিলোমিটার বৃত্তের ভেতরে দৃষ্টি দেয়া হলো।

অনুসন্ধানের নবম দিনে হাওয়াইভিত্তিক একজন সমুদ্র ভূতত্ত্ববিদ গ্রেগ কুরাস সবশেষে প্রাপ্ত ডাটা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি বিবর্ণ আঁকাবাঁকা চিহ্ন দেখতে পেলেন। ওটা কোনো ভূমি বা পাহাড়ধসের অবশেষ বলে বোঝা গেল। কিন্তু নিকটবর্তী ঢাল সেখান থেকে ২ কিলোমিটার দূরে। সুতরাং সে চিহ্ন কোনো ধসের অবশেষ নয়। তিনি তার উত্তেজনা চাপা দিতে বলে উঠলেন, হেই ব্যাটারা! এগুলোর ব্যাপারে তোমরা কী বলবে?

এএফ ৪৪৮-এর : শেষ মুহূর্তগুলো
রাত ২টার দিকে দুই কো-পাইলট বিমান পরিচালনা করছিলেন। তারা দু’ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হলেন। বিমানের অভ্যন্তরে বায়ুপ্রবাহ উত্তাল হয়ে উঠল এবং বিমানের বাইরে বাতাসের গতি মাপার জন্য যে পিটট টিউব থাকে সেটা বরফ জমে অচল হয়ে গেল। বাতাসের গতি নির্দেশক না থাকায় অটোমেটিক পাইলট ও অটো থ্রাস্ট সিস্টেম বন্ধ হয়ে গেল। তৃতীয় পাইলট পিয়েরে সেডরিক বনিন ম্যানুয়াল কন্ট্রোল হাতে নিলেন কিন্তু অতিরিক্ত ইনপুট দিয়ে ফেললেন। বিমান থেমে গেল (বিমান চলাচলের পরিভাষায় স্টলড হয়ে যাওয়া)। সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পাইলটরা সাধারণত বিমানের সম্মুখ দিক নিচের দিকে নামিয়ে দেন দ্রুত সামনে এগুনোর জন্য, এতে ডানাগুলো গতি ফিরে পায়। দুর্ভাগ্যবশত সেটা হলো না এ ক্ষেত্রে।

তিন মিনিট ধরে বিমানটি স্টলড থাকার সতর্ক সঙ্কেত উপেক্ষা করে মিনিটে ৩০০০ মিটার গতিতে মহাসাগরের দিকে নামতে থাকল। এভাবে ৫৪ সেকেন্ড চলে গেল। বিমানের ককপিট ভয়েস রেকর্ডার অনুযায়ী তখন সেখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা বিরাজ করছিল। একপর্যায়ে বনিন বললেন, আমি কোনোভাবেই বিমান নিয়ন্ত্রণে নিতে পারছি না। ১১ সেকেন্ড পর দ্বিতীয় পাইলট ডেভিড রবার্ট জিজ্ঞেস করলেন, হচ্ছেটা কী? আধা মিনিট পর রবার্ট বললেন, আমাদের এখন কী করা উচিত?

কো-পাইলট দু’জনের কারো স্টলড অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রশিক্ষণ ছিল না। অতি উঁচুতে ম্যানুয়াল কন্ট্রোল অথবা জরুরি অবস্থায় কাজ ভাগাভাগির প্রশিক্ষণও ছিল না। এয়ারবাসের ইঞ্জিন ঠিকঠাকভাবে কাজ করছিল। কেবিনে কোনো উত্তেজনা ছিল না এবং সম্ভবত নিদ্রাচ্ছন্ন যাত্রীদের ঝামেলা সম্পর্কে কোনো ধারণাও ছিল না। মহাসাগরের বুকে আছড়ে পড়ার আগ মুহূর্তে দ্বিতীয় পাইলট ডেভিড রবার্ট বলে উঠলেন, চুলোয় যাক। আমরা ক্রাশ করতে যাচ্ছি। তা যেন না হয়।

বেনিন বললেন, কিন্তু হলোটা কী? মাথা ওপরের দিকে থাকা এয়ারবাসের লেজ প্রথমে মহাসাগরে আঘাত করল এবং ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল।

অনুসন্ধান পরিচালনা প্রধান পারসেল এইউভিগুলোতে ঘটনাস্থলের উচ্চমাত্রার বিস্তারিত (হাই ডেফিনেশন) ছবি নেয়ার প্রোগ্রাম সেট করলেন। পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায় কাজ শুরু করার সময় অনুসন্ধানের পুরো সময়ের সবচেয়ে খারাপ আবহাওয়ার মুখোমুখি হতে হলো। অনুসন্ধান টিম প্রবল বাতাস এবং ঘনঘোর বৃষ্টির মধ্যে নিশ্চলভাবে অবস্থান নিয়ে থাকল। আবহাওয়া শান্ত হয়ে এলে এইউভি উদ্ধার করা হলো এবং ডাটা ডাউনলোড করা হলো।

এইউভিগুলো জাহাজের ডেকে একটি বোল্ট দিয়ে আঁটকানো কনটেইনার দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছিল। এখন কৌতূহলী চোখের সামনে সেগুলোর চার পাশের পর্দা সরিয়ে ফেলা হলো। ফেরান্তের পক্ষে বিইএর কর্মকর্তা জিন ক্লাউডে ভিটাল জাহাজের ইন্টারনেট ব্লক করার নির্দেশ দিলেন। টিমের সবাই মনিটরের পাশে জড়ো হলো।

প্রথমে দেখা গেল এক মহিলার উজ্জ্বল বাদামি রঙের হ্যান্ডব্যাগ। তারপর নজরে এলো এয়ারক্রাফটের এঁকেবেঁকে যাওয়া কিছু অ্যালুমিনিয়ামের পার্টস এবং এএফ (এয়ার ফ্রান্স) খোদিত বিমানের একটি প্যানেল। সব কিছুই কম তাপমাত্রা ও অক্সিজেনশূন্যতার জন্য অক্ষতই ছিল। সন্দেহাতীতভাবে সেটা ছিল খোয়া যাওয়া এয়ারবাস। বিমানটির সবশেষ জানা অবস্থান থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সেটা পড়েছিল। তবে এ আবিষ্কারের পর কাউকে তেমন উচ্ছ্বসিত দেখা গেল না। পর্দায় অক্ষত মানবদেহগুলোও দেখা যাচ্ছিল। অনেকের জন্য সেগুলো দেখা ছিল অসহনীয়, বললেন পারসেল। যাহোক এটা ছিল শুরু। ২২ মাসের অনুসন্ধানের পর ফেরান্তের টিম রেকের (জাহাজের ধ্বংসাবশেষ) অবস্থান জানতে পারল। এখন তাদের বিমানের শকপ্রুফ ব্ল্যাক বক্স দুটো উদ্ধার করতে হবে। জুতোর বাক্স আকারের ব্ল্যাক বক্সে বিমানের সবশেষ মুভমেন্ট এবং পাইলটদের কথোপকথনের ইলেকট্রনিক রেকর্ড সংরক্ষিত থাকে। সেগুলো খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত প্রকৃত তদন্ত শুরু হচ্ছে না।

কয়েক দিনের মধ্যে দুর্ঘটনাস্থলের ওপর ফরাসি ক্যাবল শিপ ইলে ডি সেইন কে ঘুরতে দেখা গেল। সেটার ডেকে রোবোটিক বাহু ও রেমোরা ৬০০০ ক্যামেরা সজ্জিত একটি হলুদ বাক্স রক্ষিত ছিল। একটি ক্যাবলের সাহায্যে সেটিকে সমুদ্রতলের সামান্য ওপরে পাঠানো হলো। তারপর বিমানের ধ্বংসাবশেষের ওপর সেটি ইঞ্চি ইঞ্চি করে অগ্রসর হলো। কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ ও ফরাসি পুলিশের পদস্থ অফিসারসহ লোকজনে পূর্ণ লাউঞ্জের সবার নজর মনিটরের পর্দায়। সবাই উজ্জ্বল কমলা রঙের ব্ল্যাক বক্স দেখতে উদগ্রীব। কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল, থাম, ওটা ওখানে। কিন্তু সেটা ছিল কার্গোর দরজার একটি লক।

এরপর বালিতে একটি বাক্সের ফ্রেম যখন নজরে এলো আবার আশা জেগে উঠল। কিন্তু ড্রামটি ছিল শূন্য। ভেতরে মেমোরি মডিউল কিছ্ইু ছিল না। খোঁজ অব্যাহত রাখা হলো এবং সৌভাগ্য সূর্য উঁকি দিলো। প্রধান তদন্তকারী অ্যালেন বোলার্ড জাহাজ থেকে ফেরান্তেকে ফোন দিলেন। তিনি সেদিন রোববারেও বাগানে ছিলেন। অলিভার, আমরা ডাটা রেকর্ডার পেয়ে গেছি। আমরা এখন সেটাকে ওপরে তুলছি। পরদিন ককপিট ভয়েস রেকর্ডার উদ্ধার হলো।

৪১ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে উদ্ধার করা ব্ল্যাক বক্স দুটোকে নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমান ও পুলিশ কারে করে দ্রুতবেগে প্যারিস নেয়া হলো। ব্যুরোর ল্যাবে নিয়ে ডিভাইসগুলো আলাদা করে ফেলে শুকিয়ে নিয়ে খোলা হলো। ৭০০ দিন ডুবে থাকার পরও মেমোরি ইউনিটগুলো সম্পূর্ণভাবে ভালো ছিল। সেগুলো তাজ্জব করা কাহিনী শোনাল। দুর্ঘটনার দুই বছর দুই মাস পর বিইএ পরিচালক জিন পল ট্রয়াডেক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বললেন, আমরা ফ্লাইটটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা এখন জানি। পরবর্তী পদক্ষেপ হবে কেন ঘটেছিল সেটা জানা।

ফেরান্তে সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি বললেন, এত সব খুঁজে বের করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যতে বিমান উড্ডয়ন আরো নিরাপদ করা।
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে