শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৭:৫৯:১৫

আরব দেশগুলোর উচিত মার্কিন সাহায্যকে ‘না’ বলা: লিন্ডা এস. হার্ড

আরব দেশগুলোর উচিত মার্কিন সাহায্যকে ‘না’ বলা: লিন্ডা এস. হার্ড

লিন্ডা এস. হার্ড: পরিণতির কথা না ভেবেই ভঙ্গুর একটি অঞ্চলে গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কয়েক দশকের মার্কিন নীতি ছুঁড়ে ফেলেছেন এবং বিশ্বের দেশগুলোকে তার ইচ্ছা মেনে নেয়ার জন্য ব্ল্যাকমেইল করছেন। আর এসব বিষয় লুকাতে জোর দিয়ে বলছেন, ‘আমি কাউকে পরোয়া করি না’।

কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরাসরি ও খোলামেলা এমন ব্ল্যাকমেইল নীতি আমি কমই প্রত্যক্ষ করেছি, যেমনটি ট্রাম্প ও তার নারী সহযোদ্ধা নিকি হ্যালি অধিকৃত জেরুজালেমের মর্যাদা নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভোটের সন্ধ্যায় করেছেন। তারা অর্থনৈতিকভাবে ভোগান্তির শিকার দেশগুলোর মাথায় আঘাত করার জন্য আমেরিকার ডলারকে রূঢ়ভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

নানা কারণে দরিদ্র বিভিন্ন দেশকে দেয়া অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার এবং জাতিসংঘে দেয়া ফান্ড বন্ধের হুমকি দিয়ে ভোটকে প্রভাবান্বিত করতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যাতে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ প্রস্তাব থেকে তাদের দূরে সরানো যায়। বিষয়টি নির্লজ্জভাবে অগণতান্ত্রিক। এতে মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণায় রাশিয়ার কথিত হস্তক্ষেপও তুলনামূলকভাবে বিবর্ণ হয়ে গেছে।

হ্যালি একজন কূটনীতিক হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ পরিষদের ভোটের আগে ১৮০টি দেশকে যে চিঠি দিয়েছেন তাতে ‘নাম লিখে রাখার’ বিষয়টি বলেছেন স্কুলের হেডমাস্টারের মতো। তিনি সভাস্থল ত্যাগ করেছেন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে।

জেরুজালেম ইস্যুতে ভোটাভুটি থেকে লাইচ্যুত করার জন্য হ্যালি জাতিসংঘকে ইসরাইলবিরোধী অভিহিত করাসহ নানাভাবে আক্রমণ করতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছেন। এমনকি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেছেন, ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেছেন আমেরিকার জনগণের ইচ্ছানুযায়ী। সিএনএনের এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩৬ ভাগ মার্কিনি অধিকৃত জেরুজালেমে ওয়াশিংটনের দূতাবাস সরিয়ে নেয়াকে সমর্থন করেন। এছাড়া নিকি হ্যালি ইসরাইলকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, এটি একটি বর্ণবাদী দেশ, যে কিনা অবৈধ দখলদারিত্ব কায়েম করে চলেছে।

বর্তমানে বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার বিচ্ছিন্নতা সূক্ষ্ম সুতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ছাড়া মাত্র ৭টি দেশ- গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, টোগো, মার্শাল আইল্যান্ডস, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু ও পালাউ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। আমি বিস্মিত এই ভেবে যে, এ দেশগুলোর ক’টিকে মানচিত্রে চিহ্নিত করতে পারবেন ট্রাম্প!

জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার পর থেকে ট্রাম্প প্রশাসন চেষ্টা করে এসেছে নিজেদের লক্ষ্যকে বিজয় হিসেবে বাস্তবায়ন করতে। এজন্য বিভিন্ন দেশ যেন ভোট বর্জন করে বা অন্তত ভোটাভুটিতে উপস্থিত না হয় সে চেষ্টা তারা করেছে। যেসব দেশ আমেরিকার পক্ষে গিয়ে নিজেদের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার দায়িত্ব পরিত্যাগ করেছে, তাদের প্রতি আমেরিকার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য পার্টি আয়োজন করছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি।

ট্রাম্প কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আমেরিকার অর্থ সহায়তা মূলত পররাষ্ট্রনীতি ও মার্কিন স্বার্থের পক্ষে রাখার জন্য তা গ্রহণকারীদের প্রতি একটি ঘুষ। তার কথায়, ‘যারা আমাদের অর্থ নেয় এবং নিরাপত্তা পরিষদে বা সাধারণ পরিষদের সম্ভাব্য প্রস্তাবে আমাদের বিপক্ষে ভোট দেয়, ওইসব দেশের প্রতি এবং ওই ভোটের প্রতি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।’

প্রায় সব মার্কিন মিত্র যারা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে এবং যারা অনুপস্থিত থেকেছে- তারা হোয়াইট হাউসের প্রতি স্পষ্টভাবে এ বার্তা পাঠিয়েছে যে, বিশ্বটা বিক্রি করে দেয়ার জন্য নয়।

এটি দুর্ভাগ্যজনকই বলা যায় যে, এক সময় আমেরিকার বোমা হামলা যে দেশটিকে প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে নেয়ার হুমকি তৈরি করেছিল, বছরে ৪২০ কোটি ডলার হামলাকারী দেশটি থেকে সহায়তা হিসেবে পাওয়া সেই আফগানিস্তান এবং ভয়াবহ মানবিক সংকটে ভোগা মালি প্রস্তাবের স্পন্সর হওয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার জন্য প্ররোচিত হয়েছিল, যদিও দেশ দুটি প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দিয়েছে।

‘আমরা যে আদেশ দেই বা করতে বলি তাই করো’- এর ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশকে যে সহায়তা দেয়া হয়, তা বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যে কয়টি দেশ এ সহায়তা ছাড়া নিজেদের কার্যক্রম চালাতে পারবে না, মিসর তেমনটি নয়। কায়রো আগামী বছর ১৩০ কোটি ডলার সহায়তা পাবে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে ‘অস্পর্শতুল্য ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে। এটি তারা পাবে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি মোতাবেক ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখার জন্য।

মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারকে প্রত্যাখ্যান করার কারণে আর্থিক সহায়তার কিছু অংশ কেটে নেয়া এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অর্থ দেয়ার পরও এফ-১৬ ও অ্যাপাচি হেলিকপ্টার সরবরাহ না করে ওবামা প্রশাসন মিসরকে শাস্তি দিয়েছিল। অতি সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেস মিসরে সামরিক সহায়তা স্থগিত করেছে এবং সব সহায়তা তুলে নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে।

মিসর বর্তমানে এমন অবস্থায় রয়েছে যে, সে নিজেকে এ দায় থেকে মুক্ত করতে চাইছে। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বছরের পর বছর বাড়ছে। মিসর এখন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দেশটির বিষয়ে ইতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। আগামী বছর মোট দেশজ উৎপাদনে মিসরের প্রবৃদ্ধি ৪.৪ পয়েন্ট হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যা হোক, যখন মিসর ওবামা প্রশাসন কর্তৃক পেছন দিক থেকে ছুরিকাঘাতের শিকার হয়েছে, তখন থেকে বাণিজ্য ও সামরিক ক্রয় নিয়ে প্রজ্ঞার সঙ্গে কয়েকটি শক্তিধর দেশের কাছে পৌঁছতে পেরেছে কায়রো।

মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দেশগুলোর একটি এবং জেরুজালেমের পবিত্র সাইটগুলোর রক্ষক জর্ডান ২০১৮ সালে আমেরিকার কাছ থেকে ১শ’ কোটি ডলার সহায়তা পেতে যাচ্ছে। ট্রাম্পের সহায়তা বন্ধের ঘোষণা ঐতিহাসিক হাশেমি শাসকদের প্রতি জেরুজালেমের ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এবং জর্ডানিদের অনুভূতিতে একটি বড় আঘাত- যাদের অর্ধেকই হয় ফিলিস্তিনি বা ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত।

নিশ্চিতভাবেই এটি এমন একটি সময় যখন মিসর ও জর্ডানের উচিত দড়ি কেটে দেয়ার (আমেরিকার সহায়তা সংক্রান্ত) বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা, যাতে করে আরব দেশগুলো সাময়িক সংকট কাটিয়ে তুলতে দেশ দুটিকে সহায়তার ব্যাপারে একমত হতে পারে, বিশেষত জর্ডানের ক্ষেত্রে। এতে করে আমেরিকার আধিপত্যের একটি হাতিয়ার চিরতরে ভেঙে দেয়া যাবে।
গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তর : সাইফুল ইসলাম
লিন্ডা এস. হার্ড : পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ রাজনৈতিক কলামিস্ট ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক

এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে