সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:০১:০৬

পরপর দুইটি হামলা, কারণ খুঁজছে ফ্রান্স

পরপর দুইটি হামলা, কারণ খুঁজছে ফ্রান্স

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ব্যবধানটা মাস দশেকের। গতবছরের ৭ জানুয়ারি প্যারিসে সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘শার্লি এবদো’র দফতরে তিন মুখোশধারী হামলা চালিয়েছিল। হামলার দায়ভার স্বীকার করে আইএস (ইসলামিক স্টেট)-এর তরফে জানানো হয়েছিল, হজরত মহম্মদকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের প্রতিশোধ নিয়েছে তারা। এর পর সোজা ১৩ নভেম্বর। এ বার নিশানায় ফুটবল খেলা দেখতে আসা, রক ব্যান্ডের কনসার্ট শুনতে যাওয়া সাধারণ মানুষ। কেন পরপর সন্ত্রাসের নিশানায় ফ্রান্স? সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের কড়া অবস্থানই তার প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকেরা মনে করাচ্ছেন, কয়েক দশক আগেও আফগানিস্তান এবং ইরাক নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক রাজনীতি উত্তাল, তখন ফ্রান্সকে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। আল কায়দার রোষানলেও পড়তে হয়নি ফ্রান্সকে। ইউরোপে লন্ডন বা মাদ্রিদ যে ভাবে বিস্ফোরণে কেঁপেছে, ফ্রান্সে তার আঁচ পড়েনি। তুলনায় এখন সন্ত্রাসদমন অভিযানে অনেক বেশি সক্রিয় ফ্রান্স। সে লিবিয়ার যুদ্ধ হোক বা আইএস-বিরোধী অভিযানই হোক। এমনকী পশ্চিম আফ্রিকায় প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশগুলিতে সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতাতেও বড় ভূমিকা নিয়েছে ফ্রান্স। তাই জঙ্গিদের নজর পড়েছে সাম্য ও স্বাধীনতার দেশে। বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রায় ১০ হাজার ফরাসি সেনা সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য যুদ্ধ চালাচ্ছে। ৩ হাজারেরও বেশি পশ্চিম আফ্রিকায়, ২ হাজার মধ্য আফ্রিকায় এবং ৩,২০০ ইরাকে। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ফাঁসোয়া ওলাঁদ ঘোষণা করেন, পারস্য উপসাগরে আইএস জঙ্গি দমন করতে বায়ুসেনা পাঠাবেন। এই সব কারণেই ফ্রান্সের নাম জঙ্গি-তালিকার বেশ উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী সেনাজোটে ফ্রান্সই প্রথম দেশ হিসেবে নাম লেখায়। ওলাঁদ সম্প্রতি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, এই মুহূর্তে ৫৫০ ফরাসি সেনা সিরিয়ায় যুদ্ধ করছে। গত মাসের শুরুতে সিরিয়ার রাকা শহরে একাধিক জঙ্গি ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল ফ্রান্স। তাতে বহু সিরীয় নাগরিকের প্রাণ গিয়েছে বলেও স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন সূত্রের খবর। তবে সুযোগ বুঝে গলা চড়াচ্ছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ। তিনি দাবি করছেন, এই হামলা আসলে সিরিয়া নিয়ে ভুল নীতিরই ফসল। তাঁকে স্বৈরতন্ত্রী তকমা দিয়ে আইএস-কে ডালপালা ছড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে পশ্চিমী শক্তিগুলোই। এখন তার ফল ভুগতে হচ্ছে। আসাদকে যুদ্ধ-অপরাধী সাব্যস্ত করতে চেয়ে গত সেপ্টেম্বরেই তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে ফ্রান্স। ওলাঁদ অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, আইএস-কে ছেড়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। এ বার ফ্রান্স ক্ষমাহীন ভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে।সর্বোপরি প্যারিসে হানাদারদের এক জনকে গুলি চালানোর সময় সরাসরি বলতেই শোনা গিয়েছে, ‘‘এটা সিরিয়ার জন্য।’’ গত পরশু ড্রোন হানায় কুখ্যাত আইএস জঙ্গি জেহাদি জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছিল আমেরিকা। প্যারিসে হামলা তার প্রত্যুত্তর কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়। তবে এক দিনের মধ্যে এত বড় হামলার ছক কষাটা মুশকিল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর জেহাদি জনের ‘হত্যা’য় ফ্রান্সের ভূমিকা নেই। ফ্রান্সের মানুষ অবশ্য অভিযোগ করছেন, শুধু বাইরে যুদ্ধ করলে হবে না। সমস্যা আছে ঘরেও। ফরাসি জনসাধারণের একাংশই বলছেন, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ফ্রান্সে বাইরে থেকে অস্ত্র পাচার করার সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি। ফ্রান্সের সীমান্তরেখাও ছিদ্রবহুল। ফলে সহজেই অস্ত্র জড়ো করে হামলা চালানোটা প্যারিসে যতটা সোজা, ইউরোপীয় ভূখণ্ডের অন্যত্র ততটা নয়। শার্লি এবদো-য় হামলার সময়ও বেলজিয়াম থেকে অস্ত্র আনা হয়েছিল বলে পরে জানতে পেরেছে ফরাসি প্রশাসন। কূটনীতিকদের মতে, জঙ্গি নজরে পড়ার ক্ষেত্রে ফরাসি সংস্কৃতিও অনেকাংশে দায়ী। ছবি, কবিতা, ওয়াইন আর রোম্যান্সের দেশ বলে পরিচিত ফ্রান্সের উদার, খোলামেলা আবহ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ঐতিহ্য কট্টর জঙ্গিবাদের চক্ষুশূল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ফ্রান্সের উদার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অনেকের মনেই ‘ঐতিহাসিক ক্ষোভ’ রয়েছে। যা প্রতিশোধস্পৃহা উস্কে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।’’ অভিবাসন নীতির ক্ষেত্রেও ফ্রান্স অন্য অনেকের চেয়ে বেশি নমনীয়তা দেখিয়ে এসেছে। ২৪ হাজার উদ্বাস্তু ফ্রান্সে আশ্রয় পাবে বলে ঘোষণা হয়েছে। ফরাসি নাগরিকদের মধ্যে বহু ধর্মের সহাবস্থানও অনেক দিনের। কিন্তু গত দেড় দশকে এক দিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত ও অন্য দিকে অর্থনৈতিক টালমাটালে ফ্রান্সের সামাজিক স্থিতি বেশ কিছুটা নাড়া খেয়েছিল। হিজাব পরার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ক্ষোভ বা কৃষ্ণাঙ্গ জাতিদাঙ্গা অশান্তির বীজ বুনে দিয়েছিল। ফরাসি কারাগারের একটি পরিসংখ্যান বলছে, ফরাসি জেলবন্দিদের মধ্যে ৭০%-ই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। শার্লি এবদো হামলার পরে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ হয়েছিল, ফ্রান্সের জেলেই বন্দিদের মৌলবাদে দীক্ষিত করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আর এক শিক্ষক ইমনকল্যাণ লাহিড়ির কথায়, ‘‘ফরাসি নাগরিকদের একটা বিক্ষুব্ধ অংশের সমর্থন আইএস-এর প্রতি থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’’ ১৬, নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমইউ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে