প্যারিসে বেঁচে যাওয়া সেই তরুণীর লোমহর্ষক বর্ণনা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গত শুক্রবার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ছয়টি স্থানে সন্ত্রাসীরা সমন্বিত হামলা চালালে অন্তত ১৩২ ব্যক্তি নিহত হওয়ার পাশাপাশি আরো ৩৫০ জন আহত হয়। রাজধানী প্যারিসের বাতাক্লাঁ কনসার্ট হলের সামনে ঘটেযাওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন ২২ বছর বয়সী দক্ষিণ আফ্রিকার ওই তরুণীর নাম ইসোবেল বাউডেরি। মৃতদেহগুলোর নিচে তিনি এক ঘণ্টা লুকিয়ে থেকে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছেন। তার এ বেঁচে যাওয়ার গল্প তিনি বলেছেন ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। রোববার পর্যন্ত এটি ছয় লাখ বার শেয়ার হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। পোস্টটির সঙ্গে রক্তের দাগমাখা একটি টি-শার্টের ছবিও পোস্ট করেন, যেটি তিনি নিজেই পরেছিলেন হামলার সময়।
কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করা তরুণীর ফেসবুকে বলেন, ‘এটা কেবল সন্ত্রাসী হামলা নয়, এটা ছিল হত্যাযজ্ঞ। আমার সামনে বহু মানুষকে গুলি করা হলো। মেঝেতে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। নারী বন্ধুদের মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে থাকা পূর্ণ বয়স্ক পুরুষদের কান্না ছোট মিউজিক ভেন্যুটাকে বিদ্ধ করল। মুহূর্তেই ভবিষ্যৎ গুঁড়িয়ে গেছে, সব পরিবারের হৃদয় ভেঙে গেছে। কঠিন অভিঘাত পেয়ে একা আমি এক ঘণ্টা ধরে নিজে মৃত হওয়ার ভান করেছি।’
তিনি বলেন, ‘গুলির শব্দ না শোনা পর্যন্ত বোঝাই যায়নি, কী ঘটতে যাচ্ছে। আমেরিকার রক ব্যান্ড ‘ঈগলস অব ডেথ’ মঞ্চে এক ঘণ্টা ছিল। হঠাৎ দর্শকের পেছন থেকে গোলাগুলি শুরু হয়। সংগীতের উচ্চ স্বর ও দর্শকের উত্তেজনায় গুলির শব্দ প্রথমে খেয়াল করেনি। শেষপর্যন্ত বন্দুকধারীরা সমানে থেকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তারা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি করছিল। আমি জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে এর মধ্যেই ছিলাম। এটা বাস্তব মনে হচ্ছিল না। আমি ভাবছিলাম, কেউ হয়তো বলবে এটা দুঃস্বপ্ন। বন্দুকধারীরা মৃত মানুষের আশপাশে ঘুরছিল শকুনের মতো, এই দৃশ্য তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। বাতাক্লাঁ মিউজিক ভেন্যুটি ১৫ মিনিটের মধ্যেই যেন কসাইখানা হয়ে ওঠল।’
তরুণী বলেন, ‘যে লোকটা আমাকে অভয় দিয়েছেন এবং চেষ্টা করেছেন নিজের জীবন বাঁচাতে। একই সময় তিনি আমার মস্তিষ্ককে ঢেকে রেখেছিলেন তার প্রতি ভালোবাসার শেষ কথা বলা ওই দম্পতির প্রতি, যাদের কারণে পৃথিবীর মঙ্গলে আমার বিশ্বাস জন্মে যে পুলিশ সদস্যরা শত শত মানুষকে উদ্ধার করেছে তাদের প্রতি, সম্পূর্ণ অচেনা যে লোকটা আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ৪৫ মিনিট ধরে বোঝাল, যে ছেলেটাকে আমি ভালোবাসতাম সে এখন মৃত সেই লোকের প্রতি, যে আহত লোকটাকে আমি ভুল করে ওকে ভেবেছিলাম এবং তারপর বুঝলাম সে আমুরি নয়, সে ভীষণ একা ও ভয় পাওয়ার পরও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল যে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, যে নারী বেঁচে যাওয়া মানুষের জন্য দরজা খুলে দিল তার প্রতি, যে বন্ধু আমাকে আশ্রয় দিল এবং আমার জন্য নতুন পোশাক কিনতে গেল, যাতে আমাকে রক্তমাখা শার্ট পরতে না হয় তার প্রতি, আপনাদের সবার প্রতি, যারা সমর্থন জুগিয়েছেন, যাদের কারণে পৃথিবীটা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে বিশ্বাস হচ্ছে, তাদের প্রতি বলছি এঘটনা যেন আর না ঘটে।’
ওই তরুণী আরো বলেন, ‘অচেনা মানুষের রক্তের মধ্যে আমি শুয়েছিলাম এবং অপেক্ষা করছিলাম একটি বুলেট এসে আমার ২২ বছর বয়সী জীবনটাকে শেষ করে দেবে। ঠিক সে মুহূর্তে আমি যাদের ভালোবাসি, তাদের প্রতিটা মুখ কল্পনা করছিলাম আর বলছিলাম, আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি। ফিসফিস বলছিলাম, আমি ভালোবাসি, বারবার বারবার।’
উল্লেখ্য : শুক্রবারের দুঃস্বপ্নের রাতের পর এখন পর্যন্ত রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। সন্ত্রাসী হামলার জায়গাগুলোতে রক্তের দাগ এখনো স্পষ্ট। নিহতদের স্মরণে ফুলের তোড়া রেখে গেছে অনেকে। ভয় আর আতংকে প্যারিস এখন জড়োসড়ো। ভয়াবহ জঙ্গিহানার পরেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা ফ্রান্সকে। পরিস্থিতি এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও আর কোনও জঙ্গি লুকিয়ে রয়েছে কি না, তার খোঁজে চলছে চিরুনি তল্লাশি। হামলার পর থেকে যে ভাবে এগিয়েছে পরিস্থিতি। গত জানুয়ারীতে শার্লি এবডো কার্টুন ম্যাগাজিনে হামলার পর প্রশ্ন উঠেছিল- প্যারিস এখন কতটা নিরাপদ। তবে এই প্রশ্ন সত্ত্বেও প্যারিস নিয়ে কিন্তু মানুষ আতংকে ভোগেনি। সেবারের হামলার লক্ষ্য ছিল কার্টুনিষ্টরা, ইহুদীরা।
১৬ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই
�