রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৫৮:০১

বিএসএফের নজরদারিতে স্নান সারে সীমান্তের গ্রাম

বিএসএফের নজরদারিতে স্নান সারে সীমান্তের গ্রাম

রাহুল রায় : আড়াআড়ি ঝোলানো ইনসাস রাইফেলের বাঁটে আঙুল নাচাতে থাকেন বিএসএফ জওয়ান— ‘‘আরে বহেনজি, জারা জলদি নাহানা।’’ ফিতের মতো সরু নদীর বুক জল থেকে উড়ে আসে পাল্টা জবাব, ‘‘সবে তো নামলাম, কাপড়গুলো কাচতে একটু সময় লাগে তো, নাকি!’’ উর্দির খোলা চোখের সামনেই নিয়মরক্ষার আড়াল মেনে স্নান সারার সময়ে ফুনকাতলার ঘাটে এমন ঘরোয়া কথোপোকথন নিত্য দুপুরের। সুরক্ষার শাসনে গ্রামের মহিলাদের স্নানটুকুও বিএসএফের চোখের সামনে বরাদ্দ সময়ে তড়িঘড়ি সারাটাই এ গ্রামে দস্তুর। তবে এটা ‘দিনের নিয়ম’। কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে আসাদ আলি বলছেন, ‘‘এ শুধু দিনের নিয়ম বাবু। রাতে চেহারাটা বদলে যায় বিলকুল।’’ শেষ নভেম্বরের সীমান্তের চরাচর জুড়ে কুয়াশা নামতেই অনুশাসনের আড়ালে শুরু হয়ে গিয়েছে পুরনো ‘কাজকাম’, পাচারের ডাক নাম। শীর্ণ মাথাভাঙা। শিকারপুর সীমান্তের ফুনকাতলা গ্রামের নিমতলা ঘাট। ও পারে পটল-ঝিঙে আর শ্বেত-বেগুনের আবাদ নিয়ে চুপ করে রয়েছে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া। ঘন সবুজ চাষ-জমির আলপথ ধরে মিনিট পাঁচেক এগোলে ভরা গৃহস্থলি, মেঘনা। যেন, নদিয়ার আরও একটি আটপৌরে গ্রামীণ জনপদ। ভিন দেশ, পরদেশি মানুষ— টানটান বয়ে চলা শীতের মাথাভাঙা যতোই বিভেদ টেনে দিক, সীমান্ত অনুশাসনের আড়ালে ফুনকাতলার সঙ্গে জব্বর ‘সম্পর্ক’ পাতিয়ে ফেলেছে মেঘনা। ফুনকাতলার আশাদ আলির কথা ও পারে মেঘনার আলপথে দাঁড়িয়ে কবুল করছেন হামিদ শেখও। বলছেন, ‘‘দিনের বেলায় জল ভেঙে চুপিসারে চলাচল যে নেই এমন নয়। তবে রাতে কোথায় আপনাগো বিএসএফ আর আমাগো বিজিবি?’’ কুয়াশা ঢাকা শিকারপুর সীমান্ত তখন অন্য চেহারায় ফিরে যায়। গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, তখন ও পারের ‘শিসে’ সাড়া দিয়ে এ পার থেকে নদীর খোলে নেমে যায় গরুর ঢল। ভোর রাতে ঘন কুয়াশার আড়ালে ফুট দশেকের নদী পার হয়ে তারা হারিয়ে যায় মেঘনার মাঠে। শুধু গরু কেন, ঘাটের আশপাশের তারকাঁটাহীন সীমান্ত উজিয়ে অবাধে পাড়ি দেয়, নুন, চিনি, পান, সাবান, বিস্কুট, ওষুধ এমনকী বস্তা বোঝাই হাওয়াই চপ্পল। গয়ংগচ্ছ প্রহরার ফাঁক গলে মেঘনার মানুষও শিকারপুরে সেরে যাচ্ছেন মাসকাবারি বাজার। মুচকি হেসে মেঘনা গ্রামের সদ্য কিশোরী রুকসানা বলছেন, ‘‘শিকারপুরের স্টুডিও গিয়ে ছবি তুলিয়েও এনেছি আমি।’’ তা নিয়ে অবশ্য নির্বিকার শিকারপুর। চায়ের দোকানি থেকে স্টুডিও’র ফটোগ্রাফার, চোখ মটকে শুধু সাবধান করে দিচ্ছেন, ‘‘এ সব প্রশ্ন অমন সরাসরি করতে নেই কর্তা!’’ বিএসএফের শিকারপুর বিওপি-র ডেপুটি কমান্ডান্ট সুনীল কুমার পাচারের প্রশ্ন শুনে আপাদমস্তক জরিপ করে কেটে কেটে বলছেন, ‘‘ইধার কোই স্মাগলিং নাহি চালতা। নদীমে কিসিকো নাহানা ভি মানা হ্যায়।’’ যা শুনে হাসছেন শিকারপুরের অভিজিৎ মণ্ডল। মেঘনার চরে ‘খেপ’ খেলতে যাওয়া বিকেলগুলো এখনও টাটকা হয়ে রয়েছে তাঁর হাঁটুর চোটে। বলছেন, ‘‘এক ঘণ্টার ম্যাচে নগদ দেড়শো টাকা মেলে, তবে বাংলাদেশি টাকায়। সমস্যা হল অনেক সময়েই বিএসএফকে তার বখরা দিতে হয়।’’ অবাধ ‘চলাচল’টা অনেকটাই যে নির্ভর করে ব্যাটেলিয়নের ‘মেজাজ-মর্জির’ উপরে তা অবশ্য জানিয়ে রাখছেন তিনি। শিকারপুর, ভারল, ফুলবাড়ি— বেশ কিছু ক্লাবের নিমতলা ঘাট পেরিয়ে বাংলাদেশের মাঠে টুর্নামেন্ট খেলার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তেমনই এক ক্লাব-কর্তা বলছেন, ‘‘বছর কয়েক আগে যাতায়াতটা অনেক সহজ ছিল। তখন দিনে-দুপুরে খেলতে যাওয়ার মতোই পাচারকারীদেরও রাতের অপেক্ষায় থাকতে হত না।’’ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নতুন ব্যাটেলিয়ন কিঞ্চিৎ কড়াকড়ি শুরু করেছে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। স্থানীয় বাসিন্দা জয় বিশ্বাস বলছেন, ‘‘আদতে সব ব্যাটেলিয়নই সমান। দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রথম দিকে সবাই কাজ দেখাতে একটু কড়াকড়ি করে। তারপর সমঝোতা করে নেয়।’’ শিকারপুর মোড় থেকে রেন-ট্রির ছায়ায় আরও একটু এগোলে ফুলবাড়ি আউটপোস্ট। গা ঘেঁষেই ‘দু-টুকরো’ হয়ে পড়ে থাকা গ্রাম গান্ধিনা। আউটপোস্টে পরিচয়পত্র জমা রেখে এগোতেই দেখা স্থানীয় যুবক আজিজের সঙ্গে— ‘‘কি ছেঁড়া গ্রাম দেখতে এলেন?’’ গান্ধিনার এটাই ডাক নাম। দেশ ভাগের কোপ পড়েছে গ্রামের মাঝ বরাবর। গ্রামের ৩৬ ঘর মানুষ এখনও রয়ে গিয়েছেন কাঁটাতারের ও পারে। আজিজ বলছেন, ‘‘বিকেল পাঁচটায় বিএসএফ গেট বন্ধ করে দিলে ও পারের গান্ধিনার ‘দায়িত্ব’ নেয় বাংলাদেশিরা। শুরু হয় জুলুম।’’ গত তিন বছরে তা ‘চরম’ বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সে জুলুমে কখনও তাঁদের হারাতে হয়েছে জমির ফলন, কখনও গোয়ালের গরু-ছাগল। স্থানীয় বাসিন্দা চন্দন বিশ্বাস বলছেন, ‘‘জমি-ভিটে সব ছেড়ে বিশ-ত্রিশ ঘর মানুষ গত দু’বছরে চলে এসেছেন।’’ স্থানীয় এক পুলিশ কর্তা বলছেন, ‘‘যাঁরা রয়ে গিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এ পার থেকে চাল, সাবান, শ্যাম্পু নিয়ে গিয়ে ও পারে ব্যবসা ফেঁদেছেন।’’ শিকারপুর পঞ্চায়েত প্রধান বিজেপি-র জীবানন্দ সাহা অবশ্য বলছেন, ‘‘তবে কী জানেন, সবাই তো ব্যবসা করেন না। নিতান্ত সাধারণ মানুষও রয়েছেন। ভুগছেন তাঁরাই।’’ জানান, বাংলাদেশের মাটিতে থাকা গান্ধিনার ওই বাসিন্দাদের ফিরিয়ে নিতে ইতিমধ্যেই নদিয়া জেলাশাসকের সঙ্গে বার কয়েক বৈঠক করেছেন তাঁরা। জীবানন্দবাবুর আশা নির্বাচনের মুখে সরকার যদি একটু ‘নড়েচড়ে’ বসে। সেই ভরসাতেই বুক বেঁধেছে গান্ধিনা। সূত্র : আনন্দবাজার ২৯ নভেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে