তামিলনাড়ুতে ভয়াবহ বন্যায় মৃত ২৫১
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর মঙ্গলবার থেকে আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি৷ আর তার কারণেই পুরোপুরি ডুবেগেছে তামিলনাড়ুর যাবতীয় ডিফেন্স৷ গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯ সেন্টিমিটার বৃষ্টি হয়েছে রাজধানী চেন্নাইয়ে, পার্শ্ববর্তী চেম্বারমবক্কমে তার পরিমাণ ৪৭ সেন্টিমিটার৷ চেন্নাইয়ের ভিতর দিয়ে যাওয়া আদিয়ার নদীর বাঁধ এই এলাকায়৷ গত ২৪ ঘণ্টায় সেখান থেকে উপচে পড়েছে ২৫ হাজার কিউসেক জল৷ তীরবর্তী শহর ও শহরতলি এলাকা ভেসে গিয়েছে সেই জলে৷ নদীর ধারে নিম্নবিত্তদের জন্য নির্ধারিত হাউজিং বোর্ড কলোনিগুলিতে তিন তলা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে জল৷ ভেসে গিয়েছে জিনিসপত্র থেকে কোলের ছেলেমেয়ে৷ বায়ুসেনা, নৌসেনা, স্থলসেনা ও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দল (এনডিআরএফ) মিলিত উদ্যোগে নিচু জায়গাগুলি থেকে মানুষজনকে সরাচ্ছে, নৌকায় করে পৌঁছচ্ছে ত্রাণ, শুকনো খাবার৷ কিন্তু আশা দেখছেন না বাসিন্দারা৷ দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে আবহাওয়া দপ্তর ঘোষণা করেছে অন্তত ৪ দিনের আগে বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই, আর আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টি আরও বাড়বে৷ আজ বৃহস্পতিবার আকাশপথে বন্যাবিধ্বস্ত চেন্নাই, কাঞ্চীপুরম ও তিরুভল্লুর জেলা পর্যবেক্ষণ করবেন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা৷ এই পর্যন্ত পাওয়া খবরে বন্যার কারণে মৃত্যু হয়েছে ২৫১ জনের। আদিগন্ত জলের মাঝে যেন দ্বীপ হয়ে জেগে ওঠেছে চেন্নাই৷ ১০০ বছরের রেকর্ড ভাঙা তামিলনাড়ুর এই অকালবৃষ্টিকে অবশেষে জাতীয় বিপর্যয় আখ্যা দিল কেন্দ্রীয় সরকার৷ টাইমস অপ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে এখবর দিয়েছে।
মঙ্গলবার রাতেই জয়ললিতার সঙ্গে ফোনে কথা বলে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ বুধবার সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নাড্ডা ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইড়ুর সঙ্গে বৈঠক করেন মোদি৷ ভিডিয়ো কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে তামিলনাড়ুর স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গেও কথা হয়৷ পরে রাজনাথ জানান, পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়েছে, প্রয়োজন হলে পরে আরও পাঠানো হবে৷ নাড্ডা জানিয়েছেন, তামিলনাড়ুর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সেখানকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন তিনি৷ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনও জরুরি অবস্থা উপস্থিত হলে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সব রকম সাহায্য পাওয়া যাবে বলে জানানো হয়েছে৷
রাজ্যসভা ও লোকসভাতেও এ দিন তালিনাড়ুর বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়৷ রাজনৈতিক ভেদাভেদ সরিয়ে রেখে এই পরিস্থিতিতে সবাইকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন ডিএমকে সাংসদ কানিমোঝি৷ সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি প্রস্তাব দেন, তাদের সাংসদ তহবিল থেকে ৫০ হাজার থেকে ১ কোটি টাকা তমিলাড়ুর ত্রাণে দেওয়া হোক৷ এই প্রস্তাব সমর্থন করেছে বাকি সব দল৷ টুইটারে তামিলনাড়ুর পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী৷ এই বিপদের দিনে সে রাজ্যের কংগ্রেস কর্মীদের সাহায্যের ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুরোধ করেছেন তিনি৷ জয়ললিতাকে চিঠি লিখে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার৷ তামিলনাড়ু সরকার আগের দফায় ৮ হাজার কোটি টাকার ত্রাণ চাইলেও কেন্দ্র থেকে অনুমোদন হয়েছিল ৮৩০ কোটির কাছাকাছি৷ লোকসভায় এ বার সেই পরিমাণ বাড়ানোর অনুরোধ রেখেছেন এআইএডিএমকে সাংসদরা৷
তামিলনাড়ু জুড়ে এ দিন সম্পূর্ণ ধসে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা৷ সড়ক, রেল ও বিমান, সবরকম পরিষেবাই ছিল বন্ধ৷ চেন্নাই বিমানবন্দরের রানওয়ে ও টারম্যাক কয়েক ফুট জলের তলায়, সব উড়ান বাতিল করা হয়েছে৷ জলের জন্য বেরোতে না পেরে এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিতরে আটকে ছিলেন অন্তত ১৫০০ যাত্রী এবং ২ হাজারেরও বেশি বিমানকর্মী৷ তাদের বিমানবন্দরের পক্ষ তেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। আপাতত অস্থায়ী ভাবে আরাক্কোনামে নৌসেনার এয়ারবেস থেকে যাত্রিবাহী বিমানগুলিকে ছাড়া শুরু হয়েছে৷ আগামী রবিবার ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বিমানবন্দর৷ তামিলনাড়ুর একাধিক রেললাইন ভেসে যাওয়ায় বাতিল করে দেওয়া হয়েছে ৫০টিরও বেশি ট্রেন৷ সারা দিন কখনও হালকা কখনও ভারি বৃষ্টির মধ্যে বুধবার তীব্র যানজট দেখে চেন্নাই৷ শহরের সমস্ত সাবওয়ে হাঁটু থেকে কোমর জলের তলায়৷ বিদ্যুত্ সংযোগ নেই বহু জায়গায়, জলের কারণে বাসিন্দারা বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হওয়ার শঙ্কায় বহু জায়গায় কেটে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুত্য়ের লাইন৷
এটিএম বন্ধ, মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন, টান পড়েছে অবশ্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ভাঁড়ারে৷ জাফরখানপেট, সাইদাপেট, কোট্টরুপুরমের মতো দক্ষিণ চেন্নাইয়ের নিচু এলাকাগুলি গত সপ্তাহের বৃষ্টিতেই ভেসেছিল৷ এ বার বসতবাড়ির একতলা, দোতলায় ঢুকে গিয়েছে জল৷ উদ্ধারকারী দল নৌকা নিয়ে আটকে পড়া বাসিন্দাদের বিপজ্জনক হয়ে ওঠা বাড়িগুলি থেকে বাহির করে নিয়ে এসেছে সারা দিন৷ সাইদাপেট আদিয়ারের তীরবর্তী এলাকা, নদীর উপর দিয়ে যাওয়া প্রায় সবক'টি সেতু ভেসে গিয়েছে৷ যেটি এখনও জলের উপরে তাতে মারাত্মক যানজট চলেছে সারা দিন৷ ভেলাচেরি, মাদিপক্কম এলাকাগুলি জলাভূমির আশপাশে বলে সেখানে অবস্থা আরও খারাপ৷ অল্প বৃষ্টিতেই এ সব জায়গায় পানিতে ডুবে যায়, এ বার দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকায় মিশেছে বর্জ্য পদার্থও৷ ফলে আন্ত্রিকের মতো জলবাহী অসুখের প্রকোপ শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে পুরোমাত্রায়৷ চেম্বারমবক্কম ছাড়াও শহরের আশপাশের একাধিক জলাধার থেকে এ দিন অতিরিক্ত জল উপচে পড়ে শহরতলি ভাসিয়ে যায়, ফলে শহরের অবস্থা দাঁড়িয়েছে জলে ঘেরা দ্বীপের মতো৷ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে বায়ুসেনা কপ্টার থেকে ফুড প্যাকেট ফেলা হচ্ছে৷ চেন্নাইয়ের কর্পোরেশন কমিশনার জানিয়েছেন ৯ লক্ষ ফুড প্যাকেট বিলি করা হয়েছে, সাফ করা হয়েছে শহরের জরুরি রাস্তাগুলি৷ ২০০রও বেশি অস্থায়ী শেল্টার খোলা হয়েছে ঘরছাড়াদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য৷
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, চেন্নাইয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০০০ জনকে উদ্ধার করা গিয়েছে৷ গোটা রাজ্যে উদ্ধার হয়েছেন অন্তত ২০ হাজার মানুষ৷ তাম্বরম, মুদিচুর, মণিপক্কম, গুডাভাঞ্চেরি, উরাপক্কম এলাকায় ৪ স্তরের স্থলসেনা নামানো হয়েছে৷ উরাপক্কম এলাকায় জল ১০-১২ ফুট পর্যন্ত উঠে গিয়েছে বলে জানা যায়৷ বেঙ্গালুরু ও সেকেন্দ্রাবাদে তৈরি রয়েছে আরও দুই দল৷ সর্বত্র জলে ডুবে থাকার কারণে সেনাদের পৌঁছনোটাই অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে বলে এ দিন জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর৷ দিল্লি, ভুবনেশ্বর, তিরুপতি থেকে সব মিলিয়ে আরও ১৫টি এনডিআরএফ দলকে হেলিকপ্টারে পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি৷ সাইদাপেটের নিচু এলাকাগুলি থেকে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে নেমেছে নৌবাহিনী৷ নৌসেনার আইএনএস ঐরাবতকেও লাগনো হয়েছে ত্রাণ বহনের কাজে৷
৩ ডিসেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই
�