আর্থিক কেলেঙ্কারি ও মমতার বোধোদয়
অমর সাহা : পশ্চিমবঙ্গের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটনা ‘সারদাকাণ্ড’। কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। ২০১৩ সালে এই আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস হওয়ার পর সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন কলকাতা থেকে পালিয়ে যান।
পরবর্তী সময়ে ওই বছরের এপ্রিল মাসে অবশ্য তিনি ধরা পড়েন জম্মু ও কাশ্মীরের একটি হোটেল থেকে। সেই থেকে এখনো তিনি কারাবন্দী। সারদার এই আর্থিক কেলেঙ্কারির কাণ্ড ফাঁস হওয়ার পর একে একে উঠতে থাকে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম। বর্তমান ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ আর বিধায়কদের নাম।
আর এই কেলেঙ্কারির জালে আটকা পড়ে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ কুণাল ঘোষ, সাংসদ সৃঞ্জয় বসু (টুম্পা), সাবেক মন্ত্রী ও বিধায়ক মদন মিত্রসহ আরও কয়েকজন নেতা ও তৃণমূলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। যদিও এখন এঁদের মধ্যে মদন মিত্র ও কুণাল ঘোষ কারাগারে। আর সৃঞ্জয় বসু জামিনে।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর সিবিআইয়ের হাতে মদন মিত্র গ্রেপ্তারের পর রাজ্যজুড়ে শুরু হয় রাজনৈতিক তোলপাড়। মদন মিত্র ছিলেন মমতার একেবারে কাছের লোক, প্রভাবশালী মন্ত্রী। তাই মদন মিত্র গ্রেপ্তারের পর যখন তাকে আদালতে নেওয়া হতো, তখন তার সমর্থকেরা গাড়ির ওপর পুষ্পবৃষ্টি করে তাকে নিয়ে যেতেন আদালতে। শুধু কি তা-ই, মমতাও মদন মিত্রের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে কলকাতার রাস্তায় মিছিলে পা মেলান।
এমনকি তখন মদন মিত্রের গ্রেপ্তারের পর তৃণমূল নেতা–কর্মীরা ‘আমরা সবাই চোর’—এই প্ল্যাকার্ড নিয়েও মিছিল করেছিলেন। মদন মিত্রকে একজন সৎ মন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মাঠে ছিলেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। সে সময় মমতাও মদন মিত্রের পাশে দাঁড়িয়ে, মদনের গা থেকে দুর্নীতির কালিমা মুছে ফেলার জন্য কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘কুণাল চোর, টুম্পা চোর (সৃঞ্জয় বসু), মদন চোর, আমি চোর?’
কার্যত দেখা গেছে, গ্রেপ্তার হন কুণাল, টুম্পা ও মদন মিত্র। মুকুল রায়কেও কয়েক দফায় জেরা করে সিবিআই। এখন সেই মুকুল রায় ছেড়েছেন তৃণমূলের সংস্রব। উদ্যোগ নিয়েছেন মমতার বিরুদ্ধে পাল্টা আরেকটি দল গড়ার। জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেস। এই দলের নামে ভারতের নির্বাচন কমিশনে আবেদনও জমা পড়েছে। এই মুকুল রায়ই ছিলেন তৃণমূলের সেনাপতি। দলের সাধারণ সম্পাদক। তৃণমূলের দ্বিতীয় ব্যক্তি। মমতার পরে আসন।
সারদাকাণ্ড ফাঁস হওয়ার পর মমতা সরিয়ে দেন সেই মুকুল রায়কে। এদিকে সারদাকাণ্ড ফাঁস হওয়ার পর একে একে ফাঁস হতে থাকে এই তৃণমূলের জড়িত নেতাদের নাম। আর তাতেই অস্বস্তি বাড়তে থাকে দলের। মমতাও সারদাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের বাগে আনার জন্য সারদায় গচ্ছিত টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও তাতেও তেমন সফল হয়নি।
যদিও অন্তত ১৭ লাখ আমানতকারী সারদার কাছ থেকে আমানতের টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের গঠিত শ্যামল সেন কমিশনে আবেদন করেছিলেন। এই সারদাকাণ্ডের জালে যাতে আর কোনো তৃণমূলের নেতাদের নাম উঠে না আসে, সে জন্য মমতা একসময় বর্তমান কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের সান্নিধ্যেও চলে যান। কিন্তু এখন রাজনৈতিক অঙ্ক কষে ফের মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন; পাছে ভয় সংখ্যালঘুদের ভোট হারানোর।
এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইও সারদাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে বেশ কিছুদিন ধীরে চলার নীতি নিয়ে এবার আবার সোচ্চার হয়েছে। আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন। সেই নির্বাচনের আগেই নতুন করে সিবিআইয়ের তৎপরতা জোরালোভাবে শুরু হয়েছে। গত ২৮ নভেম্বর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দোরগোড়ায় ফের সিবিআই। নজরে তৃণমূলের ১৯, ভোটের মুখে আবার তেড়েফুঁড়ে তদন্ত।’
তাই সিবিআই তদন্ত জোরদার করলে তৃণমূলের আরও বহু নেতা ফেঁসে যাবেন সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে। এতে করে যে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, তা অবশ্য দলের সঙ্গে রাজনৈতিক মহলও মনে করছে। আগামী বছরে অনুষ্ঠেয় রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে বিরোধীদের মূল ইস্যু হচ্ছে সারদাকাণ্ড আর সেই সঙ্গে মদন মিত্র। মদন মিত্র দীর্ঘ ১১ মাস কারাগারে থাকার পর আলীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পরপরই সিবিআইয়ের কলকাতা হাইকোর্টে জামিন বাতিলের আবেদনের পর হাইকোর্ট মদন মিত্রের জামিন বাতিল করে দেন। এখন মদন মিত্র কারাগারে। অথচ দীর্ঘ ১১ মাসের কারাজীবনের প্রায় পুরো সময়ই তিনি কাটিয়েছেন কলকাতা পিজি হাসপাতালের ভিআইপি স্যুটে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে। এখন সেই মদন মিত্র আলীপুরের কারাগারে।
এদিকে মমতাও বুঝে নিয়েছেন মদন মিত্র এবং সারদা ইস্যু আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিপদ ডেকে আনতে পারে। দুর্নীতিবাজদের পক্ষে থাকলে মানুষ তার বিরোধিতা করবে—এটা ভেবেই মমতা ৩০ নভেম্বর হাওড়ার আমতায় এক সভায় বলেছিলেন, কোনো ব্যক্তি চুরি করলে সে চোর হয়, দল চোর নয়। এই কথা দ্বারা মমতা সারদার সঙ্গে জড়িত নেতাদের নতুন করে একটি বার্তা দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আর দল নেই। বোঝাতে চেয়েছেন, সারদার টাকা যদি কেউ নিয়ে থাকে, সেটা তার ব্যক্তিগত দায়। এর সঙ্গে দল দায়ী নয়। মমতা এদিন মূলত চোরদের পক্ষ ছেড়ে বলেছিলেন, ‘অনেক কষ্ট করে তৃণমূল দলটা চালাই। আমার বাড়ি-গাড়ি-জমি কোনো কিছু চাই না। আমি চাই তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা কষ্ট করে চলবে, তবেই মানুষ হবে।’ আরও বলেন, ‘বিলাস জীবনের কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষের জন্য কাজ করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। কেউ টাকাপয়সা চুরি করলে সে নিজে চোর হয়, দল কখনো চোর হয় না।’
মমতার এই বক্তব্যের পর একহাত নেন বিরোধী দলের নেতারা। তারা বলেই ফেলেন, এত দিন পর মমতার বোধোদয় হয়েছে। অবশেষে স্বীকার করে নিলেন তার দলে চোর আছে। সেই চোরেরা চুরি করলে তার দায় নিতে হবে তাদের নিজেদের ব্যক্তিগতভাবে, দলের কোনো দায় নয়। তাই তো কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি ও সাংসদ অধীর চৌধুরী বলেছেন, দলের মধ্যে যে চোর আছে, তা স্বীকার করে নিলেন মমতা। আরেক কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান বলেছেন, তৃণমূলে রয়েছেন অনেক মদন মিত্র। তারাও ফেঁসে যাবেন।
লেখক : প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।
০৫ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস