বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৯, ০৭:২৭:৩৭

সৌদি থেকে নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরলেন এই নারীরা

সৌদি থেকে নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরলেন এই নারীরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সোমবার রাত ২টা। হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরের দুই নাম্বার টার্মিনাল। একেক করে বের হচ্ছে সৌদি ফেরত নারী শ্রমিকরা। তাদের বেশিরভাগের পড়নে বোরকা। কালো নেকাবের ফাঁকে চোখে পড়ে তাদের ছল ছলে দৃষ্টি। মানসিক ও শারীরিক নি'র্যা'তনের শিকার নারীরা দীর্ঘ সময় বির্পয'স্ত অবস্থায় কাটিয়েছেন দেশটিতে।

টার্মিনাল দিয়ে বের হয়েই কেউ কেউ এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছিলেন। মনে হচ্ছিলো মুক্ত আকাশের পাখির মতো। তাদের নিতে কারো স্বজন এসেছেন আবার কারো আসেনি। তাদের অনেকের কাছেই ছিলো না বাড়ি ফেরার গাড়ি ভাড়া। তেমনি একজন মুন্সিগঞ্জ জগন্নাথপুরের নাজনীন আক্তার। টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার পর কোনো স্বজনের দেখা পাননি তিনি।

কেউ তাকে নিতেও আসেনি। তিনি তিন মাস আগে সৌদিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন গৃহকর্মীর কাজে। প্রথম মাস থেকেই তার উপর চলে অমানসিক নি'র্যা'তন। ভেবেছিলেন মানিয়ে নেবেন। কিন্তু কোনো ভাবেই আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিলো না। দুই মাস কাজ করলেও কোনো বেতন পাননি নাজনীন। বেতন চাইলেও চলতো আরো বেশি নির্যাতন। 

পরে খালি হাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফহোমে ছিলেন এক মাস। গতকাল রাতে আমিরাত এয়ারওয়েজ (ইকে-৫৮৪) এর একটি ফ্লাইটে দেশে ফেরেন। কিন্তু দেশে ফিরে বাড়ির যাওয়ার গাড়ি ভাড়া ছিলো না তার কাছে। পরে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগিতায় গতকাল সন্ধ্যায় তাকে বাড়িতে পাঠানো হয়। 

তার মতো নি'র্যা'তনের শিকার ১১০ নারী সৌদি আরবের রিয়াদ ইমিগ্রেশন ক্যাম্প থেকে দেশে ফিরেছেন। সোমবার বিকাল সাড়ে ৫ টার দিকে হয়রত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন ৪৫ জন। পরের ফ্লাইটে রাত ১২টায় আসেন আরো ৬৫ জন। এসব নারী শ্রমিকদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিলেন নিঃস্ব।

এদের আরেকজন বরগুনার হেনা আক্তার (৩০)। ২০১৮ সালের অক্টোবরে পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদি আরবে। গৃহকর্মীর কাজ করতেন রিয়াদে। তিনি বলেন, প্রথম একমাস ভালো গেলেও এর পরের মাস থেকে শুরু হয় নি'র্যা'তন। প্রথমে এক বেলা করে এরপর থেকে কোনো দিন খাবার দিতো না। ফ্রিজ বা খাবার রাখার র‌্যাক তালা দিয়ে রাখতো। 

কত দিন যে কেঁদেছি একবেলা খাবার খাওয়ার জন্য। তারপরও পাষানদের মন গলেনি। একবছরের মতো কাজ করেছি। কিন্তু কোনো বেতন দেয়নি। বেতন চাইলেই গায়ে হাত দিতো। মারধর করতো। ভয়ে আর বেতন চাইনি। পরে পালিয়ে দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছি।

নওগাঁর কল্পনা বেগম (২৮)। এক ছেলে আর রিকশা চালক স্বামীকে রেখে সৌদিতে গিয়েছিলেন গৃহকর্মীর কাজ করতে। সেখানে তার অভিজ্ঞতা ভ'য়ঙ্ক'র। কল্পনা বলেন, আমার ডান হাতটা গরম পানি ঢেলে দিয়েছে কফিল। ওখানে ডাক্তারও দেখাতে পারিনি। কাউকে চিনিও না। কত কষ্ট আর নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তা বলার ভাষা নেই। একবছর কাজ করছি একটা টাকাও দেয়নি। টাকা চাইলে উল্টা আরো বেশি অত্যাচর করতো। এই দেশে কি মানুষ আসে? এমন প্রশ্ন ছিলো কল্পনা বেগমের। 

দিনাজপুরের হুসনাইনা বেগম (৪০)। মাত্র তিন মাস আগে সৌদিতে যান। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় তার উপর নি'র্যা'তন। দিনমজুর স্বামী আর চার সন্তানের দিকে চেয়ে একটু সুখের আশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। হুসনাইনা জানান, প্রথম দিন যাওয়ার পরই আমাকে কিছু খেতে দেয়নি। সকালে কফিলের বাসায় যাওয়ার পর রাত বারোটায় আমাকে একটা রুটি দিয়েছে। সারাদিনে না খেয়ে একটা রুটি দিয়ে কিছু হয়?

খাবার চাইলেও গায়ে হাত দিতো। তাদের পরিবারের সবাই কথায় কথায় অত্যাচর করতো। আমি লেবানন, জর্ডানে দশ বছর ছিলাম। ওখানে তো কোনো ধরনের অত্যাচার করেনি। সৌদিতে দুই মাস কাজ করেছি এক টাকাও দেয়নি। আমি অনেক মেয়েকে দেখেছি, রাতের বেলায় কফিলরা খারাপ উদ্দেশ্যে গায়ে হাত দেয়। কফিলদের প্রস্তাবে রাজি না হলে নি'র্যা'তন করে। 

সুনামগঞ্জের জাহানার। বসে ছিলেন ট্রার্মিনালের ক্যানোপিতে। বাইরে রিকশা চালক স্বামী রিয়াজুল হক। দুই মাস আগে সৌদিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। রিয়াজুল হক বলেন, প্রতিদিন জাহানারা ফোন করে কান্নাকাটি করতো। তার হাত নাকি পুড়ে গেছে। প্রতিদিন নাকি তার কফিল অ'ত্যা'চার করে। পরে অসুস্থ হয়ে গেলে পালিয়ে দূতাবাসে চলে আসে। 

মুন্সিগঞ্জের সাফিনা খাতুন (৩২)। তিনিও চার মাসে আগে গিয়েছিলেন গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। বলেন, আমাদের বলেছিলো মাসে একহাজার রিয়াল দিবে, কিন্তু যাওয়ার পর আমাদের দিয়েছে পাঁচ’শ রিয়াল। এক মাস বেতন দেয়ার পর থেকেই অত্যাচার শুরু করে। কফিল এসে বলে তাকে হাত-পা টিপে দিতে। না দিলেই চুলে ধরে হাতের কাছে যা পায় তা দিয়েই মারে। আমার পিঠে এখনো সেই দাগ আছে। দুই মাস পর আমি পালিয়ে সেইফ হোমে চলে আসি। অত্যাচার আর সহ্য হচ্ছিলো না। 

গতকাল বিমান বন্দরে এসব নারীদের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন পোগ্রামের পক্ষ থেকে তাদের খাবার দেয়া হয়েছে। তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন। যাদের স্বজন নিতে আসেনি এবং যাদের বাড়ি ফেরার ভাড়া ছিলো না তাদের সহযোগিতা করা হয়েছে।

ঢাকার হজরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরস্থ প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, যারা দেশে ফিরেছেন তাদের বেশির ভাগই নির্যাতিত। অনেকে আছেন সৌদি গেছেন মাত্র তিন মাস হয়েছে, তারা কোনো বেতন পাননি। উল্টো নি'র্যা'তিত হয়ে অসু'স্থ হয়ে পড়েছেন। পরে ইমিগ্রেশন ক্যাম্প ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফ হোমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের দেশে আনা হয়েছে। 

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন ফেরত আসা নারীকর্মীরা নিয়োগকর্তা কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে ইমিগ্রেশন ক্যাম্প ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফ হোমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে তারা দেশে ফিরেছেন। 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে