বুধবার, ০৪ মার্চ, ২০২০, ০৪:৫০:৩৪

যে কারণে মুসলমানদের ওপর হা'মলা ঠেকায়নি দিল্লি পুলিশ

যে কারণে মুসলমানদের ওপর হা'মলা ঠেকায়নি দিল্লি পুলিশ

হারতোশ সিং বাল : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় দিল্লিতে শুরু হওয়া সা'ম্প্রদা'য়িক সহিং'সতায় খু'ন হয়েছেন ৪৮ জন। আহ'ত হয়েছেন আরো ২৫০ জন। পু'ড়িয়ে দেয়া হয়েছে চারটি মসজিদ। তিন দিন তিন রাত ধ'রে চলা ওই সহিং'সতা মূলত দিল্লির উত্তরাংশে বাস করা মুসলিমদের ওপরই চালানো হয়েছে। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। 

গত ছয় বছর ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তার ক্ষ'ম'তাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) তার সহযোগীরা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বিশাল ''ট্রো'লবাহিনী'' ও ভারতের টেলিভিশন নেটওয়ার্কের একটি বিশাল অংশ প্রতিনিয়ত সংখ্যাল'ঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর বি'রু'দ্ধে বি'দ্বে'ষ, স'ন্দে'হ ও সহিং'সতার মনোভাব গড়ে তুলেছে।

দিল্লির সহিং'সতা শুরু হয়েছে মোদি সরকারের বৈ'ষ'ম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন নিয়ে। গত ডিসেম্বরে পাস হওয়া ওই আইনের বি'রু'দ্ধে বিক্ষো'ভ করছে ভারতীয়রা, বিশেষ করে মুসলিমরা। দিল্লি হ'ত্যায'জ্ঞের আগে পার্শ্ববর্তী বিজেপিশা'সিত উত্তরপ্রদেশে ১৯ বিক্ষো'ভকারীকে হ'ত্যা করা হয়েছে। দিল্লির সাম্প্রতিক নির্বাচনে মোদির দল সাম্প্র'দায়িক প্রচারণা চালিয়েছে।

দলনেতারা নাগরিকত্ব আইনের প্র'তিবা'দকারীদের বি'রু'দ্ধে দেশদ্রো'হিতার অ'ভিযো'গ এনেছে। তাদের হ'ত্যাকারী বলে বর্ণনা করেছে। নির্বাচনে হেরে যায় বিজেপি। কিন্তু বি'ক্ষো'ভ চলতে থাকে। ২৩শে ফেব্রুয়ারি বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র'রা দিল্লির উত্তরাংশে রাস্তা আ'টকে বিক্ষো'ভরত একদল মুসলিম নারীকে সরাতে জনতাকে উ'স্কা'নি দেন। এর পরপরই সহিং'সতা ছড়িয়ে পড়ে।

এক সপ্তাহ পর ওই সহিং'সতার বিস্তৃত বর্ণনা প্রকাশ হলে তাতে দিল্লি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। বাহিনীটির বি'রু'দ্ধে হিন্দু হা'মলাকারীদের সহায়তা ও মুসলিমদের টা'র্গে'ট করার অ'ভিযো'গ ওঠে। মিশ্রের উ'স্কা'নিমূলক বক্তব্য থেকে এ সহিং'সতার সূত্রপাত। তিনি যখন ওই হু'মকি দিচ্ছিলেন, তখন তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন উত্তর দিল্লি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ভেদ প্রকাশ। তিনি মিশ্রকে কোনো বা'ধা দেননি। পরদিন দা'ঙ্গাকারীরা যখন সহিং'সতায় নামে, প্রকাশ ও তার পুলিশকর্মীদের এক হিন্দু হা'মলাকারীর সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা যায়। ওই হা'মলাকারী দিল্লি পুলিশ ও তাদের সহায়তা উদ্যাপন করছিল।

পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা খুব স্বাভাবিকভাবে হিন্দু দা'ঙ্গাকারীদের পক্ষে তাদের সমর্থন ও মুসলিমভী'তি প্রকাশ করেন। দা'ঙ্গায় গত তিন দশক ধরে হিন্দু জাতী'য়তাবা'দীরা যু'দ্ধের স্লো'গা'ন হিসেবে ''জয় শ্রীরাম'' ব্যবহার করে আসছে। দিল্লি সহিং'সতাকারীরাও হা'মলার সময় এই স্লো'গা'ন দিয়েছে। এমন খবরও প্রকাশ পেয়েছে যে, দিল্লি পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা 'জয় শ্রীরাম' বলে মুসলিমদের ওপর হা'মলা চালিয়েছে।

সত্য হিসেবে যাচাই করা নৃশং'স একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, দিল্লি পুলিশের সদস্যরা রাস্তায় পড়ে থাকা পাঁচজন গু'রুতর আহ'ত মুসলিমের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের 'জাতীয় সঙ্গীত' গাইতে বা'ধ্য করছে। তাদের ওপর নি'র্যা'তন চালাচ্ছে। ওই পাঁচজনের একজন পরবর্তীতে জ'খমে ধুঁ'কে মা'রা গেছেন। ভিডিওটির সত্যতা নি'শ্চি'ত করা হয়েছে।

গত সপ্তাহের সহিং'সতার আগেও দিল্লি পুলিশের এরকম আচরণ দেখা গেছে। ৩০শে জানুয়ারি শাহীনবাগে একজন ব'ন্দু'কধারী পুলিশের উপস্থিতিতে নাগরিকত্ব আইনের বিক্ষো'ভকারীদের ওপর গু'লি ছোড়ে। ওই ঘটনার ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায় যে, অ'স্ত্র হাতে একজন ব্যক্তি বিক্ষো'ভকারীদের দিকে মুখ করে আছেন। ধীরে-সুস্থে নিজের ল'ক্ষ্য ঠিক করে দিল্লি পুলিশের সামনে গু'লি করছে। 

পুলিশ বাহিনীটির এমন প'ক্ষপাতদু'ষ্ট আচরণ কেবল তাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগের জন্যই হয় না। তাদের বিশ্বাস, এ ধরনের কর্মকান্ডের জন্য তারা মোদি সরকারের কাছ থেকে পুরস্কৃত হবে। ভারতের ইতিহাসে আগে ঘটে যাওয়া বড় মাত্রার ধর্মীয় সহিং'সতাগুলোর দৃ'ষ্টা'ন্ত থেকে তাদের এ বিশ্বাস জো'রদা'র হয়েছে। বিশেষ করে, ২০০২ সালের গুজরাট দা'ঙ্গা ও ১৯৮৪ সালে শিখদের বি'রু'দ্ধে ঘটা দিল্লি দা'ঙ্গা।

গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অল্প সময় পর, রাজ্যের গোধরা শহরে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিন্দু ধর্মীয় স্বেচ্ছাসেবকবাহী একটি ট্রেনে আ'গুন লাগার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, মুসলিমদের একটি দল ওই আ'গুন লাগিয়েছিল। ওই আ'গুনে প্রাণ হা'রায় ৫৯ জন হিন্দু। মোদি নিশ্চিত করেন, ওই নিহ'তদের পুড়ে যাওয়া লা'শগুলো নিয়ে গুজরাটের সবচেয়ে বড় শহরে আহমেদাবাদজুড়ে যেন মহড়া হয়। মোদির দলের সঙ্গে সং'শ্লি'ষ্ট সংগঠনের নেতারা উ'স্কা'নিমূলক বক্তব্য দেন। 

তাদের বক্তব্যে জ্ব'লে ওঠে মুসলিমদের বাড়ি ও দোকানে হা'মলা চালায় উত্তে'জিত হিন্দু জনতা। ওই দা'ঙ্গায় প্রা'ণ হারান ১ হাজারের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে ৭০০’র বেশি ছিলেন মুসলিম। দিল্লি পুলিশের মতো গুজরাটের তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর বি''রুদ্ধেও দা'ঙ্গাকারীদের সঙ্গে হাত মেলানোর ও মুসলিমদের ওপর হা'মলা ঠে'কাতে কিছু না করার অ'ভিযো'গ রয়েছে। দা'ঙ্গাটি প্র'শ'মিত করতে কয়েকজন পুলিশকর্মী প'দক্ষে'প নিয়েছিলেন। 

তাদের সবাইকে ত'ড়িঘ'ড়ি করে ব'দলি করে দেন মোদি ও তার তখনকার ও এখনকার ঘনিষ্ঠ সহযোগী অমিত শাহ। পরবর্তী বছরগুলোয় ওই পুলিশকর্মীদের নানাভাবে হ'য়রা'নি করে সরকার। দিল্লি পুলিশ বাহিনীতে কাজ করা প্রত্যেক কর্মী গুজরাটের ওই পুলিশকর্মীদের ভাগ্য সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে সচেতন। দিল্লি রাজধানী হওয়ার পর থেকে শহরটির পুলিশকর্মীরা গুজরাটের তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর মতো সরাসরি মোদি সরকারের কাছে জ'বা'বদি'হিতা করে। 

কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে কাজ করে তারা। ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকা মোদির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন অমিত শাহ। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। দিল্লি পুলিশের কাছে আরো সুস্পষ্ট দৃষ্টান্তও ছিল। ১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হ'ত্যা করে তার শিখ দেহর'ক্ষীরা। এর এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু হয় ভ'য়াব'হ এক দা'ঙ্গা। সহিং'স জনতার হাতে খু'ন হয় ৩ হাজারের বেশি শিখ ধর্মাবলম্বী। 

দা'ঙ্গায় পুলিশের ভূমিকা বিস্তৃত আকারে স'মালো'চিত হয়। সরকারের নিয়োগ দেয়া এক কমিশন জানায়, বহু জায়গায় দিল্লি পুলিশ শিখদের কাছ থেকে অ'স্ত্র বা অন্যান্য হাতিয়ার, যেগুলো দিয়ে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারতো, তা কে'ড়ে নিয়েছে। তাদের র'ক্ষা করার প্র'তিশ্রু'তি দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে হা'মলা চালানো হয়েছে। এসব অ'ভিযো'গ প্রমাণের জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে। পরবর্তীকালে অপর এক কমিশন ৭২ পুলিশকর্মীকে দো'ষী সা'ব্যস্ত করে। 

এক সুপারিশে, দো'ষী সা'ব্যস্ত পুলিশকর্মীদের বি'রু'দ্ধে প'দক্ষে'প নেয়ার দায়িত্ব দিল্লি পুলিশ ব্যতীত অন্য কোনো সংস্থাকে দিতে বলে। কিন্তু ওই সুপারিশ মানা হয়নি। দা'ঙ্গায় তাদের ভূমিকার জন্য দো'ষী সা'ব্য'স্ত হওয়া সত্ত্বেও শা'স্তি থেকে বেঁচে যায় অনেকে। দিল্লি পুলিশের অনেক সদস্যই ওই কর্মীদের অধীনে কাজ করেছেন বা তাদের দ্বারা প্রশিক্ষিত হয়েছেন। মোদি সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশের জন্য সহায়তার বার্তা অটল, স্পষ্ট ও বাহিনীর ঊর্ধ্বে। 

সাম্প্রতিক সহিং'সতায় নি'ষ্ক্রি'য়তার জন্য পুলিশকে চ'রম ভর্ৎ'সনা করেন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস. মুরালিধর। দা'ঙ্গায় হিন্দু জাতীয়তাবা'দী নেতাদের ভূমিকা ত'দন্তের নির্দে'শ দেন তিনি। এর পরপরই তাকে অন্য এক রাজ্যে ব'দলি করে দেয়া হয়। তাকে ব'দলে দেয়ার সিদ্ধান্ত আগে থেকে করা থাকলেও, এর সময়কাল ঠিক করেছে মোদি সরকারই। 

এক আইনজীবী জানান, কোনো শু'নানি বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করার মধ্যে কোনো বিচারককে ব'দলির ঘটনা নজি'রবি'হীন। মোদি সরকারের বার্তা সকলের কাছেই স্পষ্ট। সংখ্যা'গরি'ষ্ঠ জনগো'ষ্ঠীর পক্ষে কাজ করা এই সরকার তাদের এজে'ন্ডা পূরণের পথে বিচার বিভাগ বা আমলাতা'ন্ত্রিক জ'টিলতাকে বা'ধা সৃ'ষ্টি করতে দেবে না।

দিল্লি সহিং'সতায় জড়িত পুলিশকর্মীরা কোনো আইনি প'দক্ষে'পের সম্মুখীন হবে না। তারা হয়তো সংবিধান মেনে চলেনি, কিন্তু তারা বিজেপিকে মেনে চলেছে। ভবিষ্যতে ভারতের মোদি সরকারশা'সিত কোনো অঞ্চলে উ'গ্র হিন্দু জনতা যখন মুসলিমদের ওপর হা'মলা চালাবে, আমরা নি'শ্চিত থাকতে পারি যে, পুলিশ তাদের সহায়তা করবে। (নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ।)

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে