শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২০, ০৭:৫৫:১১

ভেন্টিলেটারে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা করোনা রোগীর পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে যা করেন নার্স

ভেন্টিলেটারে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা করোনা রোগীর পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে যা করেন নার্স

আন্তর্জাতিক ডেস্ : করোনা ভাইরাসে আক্রা'ন্ত স'ঙ্ক'টজনক অবস্থার রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটারের ভূমিকা বিশাল। ভেন্টিলেটার থাকার ওপর অনেক সময় ওই রোগীর জীবন মৃ'ত্যু নির্ভর করে। ভেন্টিলেটার তাদের ফুসফুসে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন জোগায় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে আনে অর্থাৎ রোগী যখন নিজে নিজে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারে না, তাকে কৃত্রিমভাবে শ্বাস নেওয়ায় ভেন্টিলেটার।

কিন্তু এই ভেন্টিলেটারে দেয়ার মানে এই নয় যে এতে সব রোগীর জীবন বাঁচবে। সে কারণেই এখানে চিকিৎসকদের সিদ্ধান্ত নেবার বিষয় থাকে যে কখন তারা মনে করবেন সেই রোগীর আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই, এবং ভেন্টিলেটার চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে হবে। "ভেন্টিলেটার বন্ধ করে দেয়াটা খুবই মানসিক চা'পের এবং ক'ষ্টের মুহূর্ত। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওই ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী," বলছেন জুয়ানিতা নিত্তলা।

লন্ডনের রয়াল ফ্রি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের প্রধান নার্স তিনি। দক্ষিণ ভারতে জন্ম নিত্তলা ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবায় (এনএইচএস) কাজ করছেন গত ১৬ বছর ধ'রে। তিনি নিবিড় পরিচর্যা সেবায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত নার্স। "ভেন্টিলেশন বন্ধ করাটাই আমার কাজ," বিবিসিকে বলছিলেন ৪২ বছরের এই নার্স।

শেষ ইচ্ছা : এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক সকালে নিত্তলা যখন তার শিফটে যোগ দিলেন নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) -এর ডাক্তার তাকে বললেন কোভিড -১৯ এর একজন রোগীর চিকিৎসা তাকে বন্ধ করে দিতে হবে। রোগী ছিলেন পেশায় একজন কমিউনিটি নার্স - ৫০এর কোঠায় বয়স। নিত্তলা তার মেয়েকে জানালেন গোটা প্র'ক্রিয়া সম্পর্কে।

"আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম তার মায়ের কোন কষ্ট হচ্ছে না। তিনি খুব প্রশান্তির মধ্যে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম তার মায়ের কোন শেষ ইচ্ছা আছে কি না এবং ধর্মীয়ভাবে তিনি কিছু চান কিনা।" আইসিইউতে বিছানাগুলো পাশাপাশি। নিত্তলার চারপাশে যত রোগীর তিনি দেখাশোনা করছেন তারা সবাই অচেতন। "সব রোগীই গু'রুতর অসুস্থ। আমি ওই রোগীর চারপাশ পর্দা দিয়ে ঘিরে দিলাম। এবং সবরকম অ্যালার্ম বা সত'র্কস'ঙ্কেত ব'ন্ধ করে দিলাম।"

সব চিকিৎসা কর্মী কয়েক মুহূর্তের জন্য কাজ বন্ধ রাখলেন। "নার্সরা কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। রোগীর সম্মান এবং তাকে স্ব'স্তি দেওয়াটাই তখন আমাদের অগ্রা'ধিকার," বললেন নিত্তলা। নিত্তলা রোগীর কানের কাছে ফোন ধ'রলেন এবং তার মেয়েকে বললেন "কথা বলুন"। "আমার কাছে ওটা একটা ফোন কল মাত্র। কিন্তু তার পরিবারের জন্য ওটা ছিল বিশাল পাওয়া। ওরা চেয়েছিলেন ভিডিও কল করতে। কিন্তু দুভা'র্গ্যবশত আইসিইউ-র ভেতরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমতি নেই।"

মেশিন বন্ধ : রোগীর পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী, নিত্তলা কমপিউটার থেকে একটা নির্দিষ্ট মিউজিক ভিডিও বাজালেন। এরপর তিনি গিয়ে ভেন্টিলেটারের সুইচটা বন্ধ করে দিলেন। "আমি তার পাশে বসলাম, যতক্ষণ না প্রাণবায়ু বেরলো আমি তার হাত ধ'রে পাশে বসে রইলাম।" নি:শ্বাস নেবার জন্য সবরকম সহায়তা সরঞ্জাম এবং চিকিৎসা ব'ন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন শুধু ডাক্তাররা এবং সেটা তারা নেন খুবই সত'র্কতার সঙ্গে সব দিক বিবেচনা করে, যেমন রোগীর বয়স, তার আর কোন অসুখ আছে কি না, তিনি চিকিৎসায় কেমন সাড়া দিচ্ছেন, তার সেরে ওঠার সম্ভাবনা কতটা, সবদিক বিশ্লেষণ করে। ভেন্টিলেটার যন্ত্র বন্ধ করে দেবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওই রোগী মা'রা গেলেন। "আমি মনিটারে দেখলাম আলো ফ্লাশ করছে এবং মনিটারের পর্দায় হৃদস্পন্দন থেমে যাবার যান্ত্রিক স'ঙ্কে'ত।"

একাকী মৃত্যু : তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য নলের মাধ্যমে যেসব ওষুধ দেয়া হচ্ছিল সেসব নল খুলে দিলেন নিত্তলা। রোগীর মেয়ে যেহেতু জানতেন না যে কী হচ্ছে, তিনি তখনও তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিলেন। তিনি ফোনে তাকে কিছু প্রার্থনার কথা শোনাচ্ছিলেন। নিত্তলার খুব কষ্ট হচ্ছিল তাকে বলতে, কিন্তু তারপরেও ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে তাকে বলতে হল তার মা মা'রা গেছেন। একজন নার্স হিসাবে, তিনি বলছেন, একজন রোগী মা'রা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।

"একজন সহকর্মীর সাহায্য নিয়ে আমি তাকে পরিষ্কার করলাম, সাদা কাপড়ে মুড়ে তার লাশ বডি ব্যাগে ঢোকালাম আর ব্যাগ বন্ধ করার আগে আমি রোগীর কপালে ক্রশ চিহ্ন এঁকে দিলাম ধর্মীয় রীতি মেনে" বিবিসিকে বলছিলেন নিত্তলা। করোনা ভাইরাসের এই প্রাদু'র্ভাবের আগে কোন রোগীর চিকিৎসা বন্ধের আগে ডাক্তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেন।

কৃত্রিম শ্বা'সব্যবস্থার য'ন্ত্র বন্ধ করে দেবার আগে নিকট আত্মীয়দের আইসিইউতে ঢুকতে দেয়া হতো। এখন করোনা থেকে সং'ক্র'মণের আশং'কায় বিশ্বের বহু দেশে এটা বন্ধ হয়ে গেছে। "একাকী এভাবে মা'রা যাওয়াটা গভীর দু:খের," নিত্তলা বলছিলেন। তিনি বলছেন যারা মৃত্যু পথযাত্রী তাদের সাহায্য করতে পারার মধ্যে দিয়ে মানসিক য'ন্ত্র'ণা কা'টিয়ে ওঠার চেষ্টা তিনি করছেন। তিনি এমন রোগী দেখেছেন যারা শ্বাস নিতে পারছেন না, যাদের দ'ম আ'টকে যাচ্ছে- "এটা চোখে দেখা খুবই কষ্টের।"

বিছানা নেই : হাসপাতালগুলোতে এত মানুষ ভর্তি হচ্ছে যে হাসপাতালগুলোতে স'ঙ্ক'টাপন্ন রোগীদের বিছানা দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। সব বিছানা রোগীতে ভর্তি। আমাদের হাসপাতালে আইসিইউতে বিছানা ছিল ৩৪, এখন ৬০। ১৭৫ জন নার্স দিবারাত্র শিফটে ডিউটি করছে। "সাধারণ সময়ে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে প্রতি রোগীর জন্য একজন করে নার্স দায়িত্বে থাকে। এখন একজন নার্স তিনজন রোগীকে দেখছে। অবস্থা আরও খা'রাপ হলে একজন নার্সকে ছয়জন করে রোগীর দেখভাল করতে হবে।"

তার টিমের কয়েকজন নার্সের উপসর্গ ধ'রা পড়েছে। তারা স্বেচ্ছা আইসোলেশনে আছে। হাসপাতাল অন্য নার্সদের দ্রুত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে যাতে তারা প্রয়োজনে হাল ধ'রতে পারে। "শিফট শুরু করার আগে আমরা সবাই পরস্পরের হাত ধ'রে বলি 'নিরাপদে থেকো'। আমরা অন্যদের চোখে চোখে রাখি। আমরা খেয়াল রাখি সবাই গ্লাভস, মাস্ক এবং ঠিকমত পিপিই পরছে কি না," নিত্তলা বলেন।

ভেন্টিলেটার, পাম্প, অক্সিজেন সিলিন্ডার অনেক ওষুধ সবকিছুরই অভাব এখন। তবে তার হাসপাতালে পুরো টিমের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই আছে। "প্রতিদিন আইসিইউ-তে একজন করে মা'রা যাচ্ছে। মহামা'রির আগের চেয়ে এ সংখ্যা অনেক বেশি," জানালেন নিত্তলা। নার্স টিমের প্রধান হওয়ার কারণে তিনি অনেক সময় তার ভ'য় চে'পে রাখেন। "রাতের বেলা আত'ঙ্ক আমায় গ্রা'স করে। আমি ঘুমতে পারি না। খালি মনে হয় আমি ভাইরাস আক্রা'ন্ত হবো। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলি। সবাই ভ'য়ে আছে।"

গত বছর তার যক্ষ্মা ধ'রা পড়েছিল। অনেক দিন কাজে যেতে পারেননি। তিনি জানেন তার ফুসফুসের জো'র কম। "সবাই বলছে তুমি কাজে যেও না। কিন্তু এখন মহামা'রি চলছে। সব ভাবনা সরিয়ে রেখে কাজ করছি।" "প্রত্যেকদিন শিফট শেষে আমার পরিচর্যায় থেকে যারা মা'রা গেলেন তাদের কথা ভাবি। কিন্তু চেষ্টা করি হাসপাতালের বাইরে পা রাখার পর সব চিন্তা, যতটা পারি মাথা থেকে সরিয়ে দিতে।" সূত্র : বিবিসি বাংলা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে