আন্তর্জাতিক ডেস্ক : লিবিয়ায় সম্প্রতি বিদ্রো'হী নেতা জেনারেল খলিফা হাফতারের বাহিনীকে যেভাবে হ'টিয়ে দিয়েছে ত্রিপোলির সরকারের বাহিনী – তাতে ক্র'মশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে দেশটির ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহের প্রচ্ছন্ন নিয়ন্তা হয়ে উঠতে চলেছেন রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন ও তুরস্কের রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান– ঠিক যেমনটা সিরিয়ায়।
২০১১ সালে লিবিয়ার শাসক কর্নেল গাদাফি ক্ষ'মতাচ্যুত ও নিহ'ত হবার পর দেশটির রাষ্ট্রকাঠামো ভে'ঙে পড়েছে, চলছে গৃহযু'দ্ধ, যাতে জড়িয়ে পড়েছে বিদেশি শক্তিগুলোও। ত্রিপোলিতে জাতিসংঘ সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সেরাজের সরকার ক্ষমতাসীন কিন্তু তাদের মো'কাবিলা করতে হচ্ছে লিবিয়ার নানা অংশ নিয়'ন্ত্রণকারী বিভিন্ন বিদ্রো'হী গোষ্ঠীর।
গত বছর থেকেই লিবিয়ার পূর্বাংশ নিয়'ন্ত্রণকারী সামরিক নেতা জেনারেল খলিফা হাফতার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন ত্রিপোলি দ'খল করার কিন্তু তার বাহিনী এখন ত্রিপোলির সরকারের আ'ক্র'মণের মুখে পিছু হটছে। ত্রিপোলি সরকারের সমর্থনে এখন সেনা সহায়তা দিচ্ছে তুরস্ক এবং এই সৈন্যদের মধ্যে আছে সিরিয়ার তুরস্ক-সমর্থিত বাহিনীর যো'দ্ধারা ।
অন্যদিকে, জেনারেল হাফতারের বাহিনীতে আছে কয়েক হাজার রুশ ভাড়াটে সৈন্য। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে দেশটির বেসামরিক জনগণ আগামীতে একটা শান্তিপূর্ণ সময় প্রত্যাশা করতে পারে। অথচ এমনকি কর্নেল গাদাফির প'তনের পরও একটা সময় পর্যন্ত মনে হচ্ছিল - দেশটির সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। তেল এবং গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ লিবিয়া। পর্যটকদের জন্যও দেশটি হতে পারতো আকর্ষণীয় গন্তব্য। লিবিয়ার আছে ২০০০ কিলোমিটার ভূমধ্যসাগরতীবর্তী সৈকত।
সেখানে রোমান যুগের এমন সব পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে– যা ইতালির সমকক্ষ বলে দাবি করা চলে। জ্বালানি সমৃদ্ধ দেশটির পক্ষে তার নাগরিকদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নত জীবনযাত্রার মান নি'শ্চিত করা অসম্ভব নয়। কিন্তু এখন তাদের এগুলো কিছুই নেই, নেই জীবনের নিরা'পত্তাও। কোভিড-১৯ সং'ক্র'মণের মধ্যে দেশটির হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর বেশির ভাগই ধ্বং'স হয়ে গেছে।
পশ্চিম লিবিয়ার ২ লাখ লোক ইতিমধ্যেই তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। লিবিয়ার শহরগুলো এখন এক একটি নগররাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিদ্রো'হী মিলিশিয়ারা যারা গাদাফির শা'সকচক্রকে মো'কাবিলা করেছিল – তারা তার প'তনের পর ক্ষমতার মজা পেয়ে গেছে। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব এজেন্ডা আছে, তারা অ'স্ত্র সমর্পণ করবে না। জাতিসংঘের উদ্যোগে কূটনীতিকরা চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে সংলাপ ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার – কিন্তু তা সফল হয়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হানান সালেহ বলছেন, গৃহযু'দ্ধরত সব পক্ষই বেসামরিক মানুষদের প্রতি একই রকম নি'র্ম'ম আচরণ করেছে, তবে বিশেষ করে খলিফা হাফতারের বাহিনী এমন সব অত্যা'চার-নি'র্যাতন চালিয়েছে যা যু'দ্ধাপরা'ধ বলেও বিবেচিত হতে পারে।
বিদেশি শক্তিগুলো লিবিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে : লিবিয়ার দ্বিতীয় প্রধান শহর বেনগাজির ইসলামি উ'গ্রপ'ন্থীদের তাড়িয়ে জেনারেল খলিফা হাফতারের উ'ত্থান ঘটে ২০১৪ সালে। জেনারেল হাফতার লিবিয়ায় সুপরিচিত কর্নেল গাদাফির সাথে তার বৈ'রিতার জন্য। তিনি নির্বাসিত হিসেবে অনেক বছর আমেরিকা ভার্জিনিয়ার ল্যাংলিতে কাটিয়েছেন। এই শহরেই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর প্রধান দফতর।
এখানে বসেই গাদাফির প'তনের ছ'ক আঁটতেন জেনারেল হাফতার। এখন তিনি বেনগাজির নিয়'ন্ত্রক এবং ত্রিপোলিতে অভিযান চালিয়ে তিনি চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফায়েজ আল সেরাজের সরকারকে উৎ'খাত করে লিবিয়াকে আবার এক রাষ্ট্রে পরিণত করতে। তখন থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে এখানে বিদেশি শক্তি জড়িয়ে পড়বে।
বিদেশি শক্তিগুলো কী চায় : নিয়'ন্ত্রণকামীদের কাছে লিবিয়া এক আকর্ষণীয় দেশ। জনসংখ্যা ৭০ লাখেরও কম, কিন্তু আফ্রিকার সবচেয়ে বড় তেল-গ্যাসের রিজার্ভ আছে এখানে। এর অবস্থান ইউরোপের ঠিক উল্টো দিকেই। এখানকার হাইড্রোকার্বন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সরাসরি রফতানি হতে পারে।
অন্যদিকে উপসাগরীয় এলাকার প্রতিদ্ব'ন্দ্বী তেল-গ্যাস উৎপাদকদের জাহাজগুলোকে আসতে হয় বি'প'জ্জনক সমুদ্রপথ দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজকে সমর্থন করছে তুরস্ক, কাতার ও ইতালি। জেনারেল হাফতারকে সমর্থন করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, মিশর, রাশিয়া এবং ফ্রান্স।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য একেক সময় একের রকম রাজনৈতিক সংকে'ত দিয়েছে। কখনো সেরাজ, কখনো জেনারেল হাফতারকে উৎসাহ দিয়েছে। আবার যখন নাগালে পেয়েছে তখন ইসলামি উ'গ্রপ'ন্থীদের ওপর বোমা হা'মলা চালিয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ভ'য়, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো লিবিয়ায় নিজের প্রভাব কায়েম করবেন, ঠিক যেভাবে তিনি সিরিয়ায় করেছেন।
লিবিয়ার সাথে সিরিয়ার অনেক মিল দেখা যাচ্ছে : লিবিয়ার যু'দ্ধের সাথে সিরিয়ার অনেক মিল দেখা যাচ্ছে। সিরিয়ায় যেমন, ঠিক তেমনি লিবিয়ারও ভবিষ্যৎ ভাগ্যের নিয়ন্তা হয়ে উঠছেন সেই একই বিদেশি নেতারা। অনেক দিক থেকেই সিরিয়ার প্রক্সি যু'দ্ধের ধারাবাহিকতাতেই যেন চলছে লিবিয়ার যু'দ্ধ। তুরস্ক এবং রাশিয়া– দু পক্ষই লিবিয়ায় নিয়ে গেছে সিরিয়ান মিলিশিয়াদের– যারা নিজেদের দেশের এক দশকব্যাপী গৃহযু'দ্ধের মধ্য দিয়ে দক্ষ যো'দ্ধা হয়ে উঠেছে।
এটা হতেই পারে যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়ায় করা চুক্তিগুলোরই একটা সংস্করণ লিবিয়ার ওপর প্রয়োগ করছেন। জেনারেল হাফতারের পক্ষে যে রাশিয়ান ভাড়াটে সৈন্যরা যু'দ্ধ করছে তারা এসেছে ওয়াগনার গোষ্ঠী নামে একটি সংগঠন থেকে।
এটি চালান প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন। এই ওয়াগনার গ্রুপের যো'দ্ধাদেরকে সিরিয়াতেো ব্যবহার করা হয়েছে। এটা লক্ষ্য করার বিষয় যে ত্রিপোলি থেকে রাশিয়ানদের প্র'ত্যা'হার করে নেবার সময় তুরস্ক তাদের সামরিক ড্রোনগুলো ব্যবহার করে তাদের হ'য়রানি করেনি। তা ছাড়া রাশিয়ানরা লিবিয়াতে উন্নত প্রযুক্তির যু'দ্ধবিমানও লিবিয়ায় নিয়ে গেছে।
পরবর্তী বড় যু'দ্ধ তাহলে কী : প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান হয়তো জেনারেল হাফতারের ত্রিপোলি অভিযান বন্ধ করতে রাজি হয়েছেন– যাতে তারা যু'দ্ধ থেকে পাওয়া সুবিধাগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। লিবিয়ার ভে'ঙে পড়া নিয়ে একটি বই লিখেছেন জার্মান শিক্ষাবিদ ওলফ্রাম লাশার।
তিনি বলছেন, হয়তো দুটি বিদেশি শক্তি লিবিয়ায় নিজ নিজ প্রভাব বলয়ের সীমারেখা চি'হ্নিত করে নিয়েছে। এমনও হতে পারে যে এই ব্যবস্থাটা হয়তো দীর্ঘদিন জারি থাকবে। তবে লিবিয়ায় স'ক্রিয় অন্য বিদেশী শক্তিগুলো এবং লিবিয়ার জনগণ এটা মেনে নেবে কিনা তাতে সন্দে'হ আছে। হয়তো ত্রিপোলি থেকে ৫৫ মাইল দূরের তারহুনা শহরটি নিয়েই হতে পারে পরবর্তী বড় যু'দ্ধ।
পশ্চিম দিকের এই শহরটি জেনারেল হাফতারের ঘাঁটি, এবং এটি নিয়'ন্ত্রণ করে আল-কানিয়াত নামে একটি মিলিশিয়া গোষ্ঠী যা প্রধানত গাদাফি সরকারের অনুগতদের নিয়ে গড়া। এ মুহূর্তে ত্রিপোলি সরকারের অনুগত বাহিনী তারহুনার দিকে এগুচ্ছে – যারা একসময় ছিল গাদাফি সরকারের বিরো'ধী। বোঝা যাচ্ছে, লিবিয়ার বিরামহীন গৃহযু'দ্ধে গাদ্দাফির সমর্থকদের বিরু'দ্ধে লড়াই এখনো গুরুত্বপূর্ণ। সূত্র: বিবিসি বাংলা