শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০২০, ০৪:৩৪:৪১

শুধু চীন না, অন্যান্য প্রতিবেশীদের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কের অবনতি

শুধু চীন না, অন্যান্য প্রতিবেশীদের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কের অবনতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের গণমাধ্যমের একাংশ আর সামাজিক মাধ্যমে দুটো ঘ'টনার তুলনা টানছেন অনেকেই। ২০১৯ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি আর ২০২০ সালে ৫ই মে। প্রথম ঘ'টনাটি ছিল পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ''সার্জি'কাল স্ট্রা'ইক'' আর দ্বিতীয়টি যেদিন চীনা ফৌজ লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা আর পাংগং হ্রদের ধা'রে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করেছিল।

দুটি দিনের তুলনা টেনে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম লিখছে, যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার গোটা সরকার বালাকোট হা'মলার দিন উচ্চ'কিত হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু তারা চীনা বাহিনীর অগ্র'সর হওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন চু'প করে থেকেছেন। এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ভারতের বিদেশ নীতি নিয়েই।

কারণ যে সময়ে চীনের সঙ্গে সং'ঘ'র্ষে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহ'ত হলেন সেই সময়েই বুধবার নেপালের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সেদেশের নতুন ম্যাপ সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হলো - যাতে ভারতের কিছুটা অংশও রয়েছে বলে নতুন দিল্লির অ'ভিযো'গ। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধ'রেই খা'রাপ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চীনের সঙ্গেও মতবিরো'ধ ছিলই। কিন্তু নেপালের মতো ভারতের বন্ধু রাষ্ট্রও এখন ক'ঠো'র অবস্থান নিচ্ছে।

এর আগে বাংলাদেশের তিনজন মন্ত্রী ভারত সফর বাতিল করেছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন বাংলাদেশ সহ প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সংখ্যাল'ঘুদের নিজেদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য নতুন আইন করেছিল ভারত। যদিও ওই আইন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বারেবারেই বলেছে যে আইনটি ভারতের অভ্যন্তরীন বিষয়। এই ঘ'টনাগুলি থেকেই প্রশ্ন উঠছে যে কেন গত কয়েক বছর ধরে নিকটতম প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অব'নতি হচ্ছে?

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অশ্বিনী রায় বলছিলেন, এই অঞ্চলের প্রতিটা দেশই বোঝে যে চীন-ভারত সম্পর্কের ওপরেই নির্ভর করছে তারা নিজেরা কতটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারবে। তিনি বলেন, ''নেপাল এই সুযোগটা আগে থেকেই নিয়েছে। এখন আরও বেশি করে সুযোগের সদ্বব্যবহার করছে।" তিনি বলছিলেন, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বৈদেশিক সম্পর্ক ভারতের থেকে অনেক উন্নত।

অশ্বিনী রায় বলেন, ''তারা বেশ আগ্রা'সী মনোভাব নিয়েই এই অঞ্চলে কাজ করে, তারই ফলশ্রুতি এখন দেখা যাচ্ছে নানা দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। আমরা প্রকৃত অর্থেই নিজেদের জমি হা'রাচ্ছি।" ভারতে গত কদিন ধ'রে ব্যা'পক চীন বিরো'ধী বিক্ষো'ভ চলছে - চীনের পতাকা পোড়ানো হচ্ছে - চীনা পণ্য বয়কট করার আহ্বান দেওয়া হচ্ছে।

নেপালের সঙ্গে বিবাদ : যখন এরকম একটা চীন বিরো'ধী মনোভাব ভারতের সাধারণ মানুষের একাংশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সেই সময়েই আরেক প্রতিবেশী নেপাল তাদের দেশের নতুন মানচিত্র পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে নিয়েছে - যাতে ভারতের কিছুটা অংশও রয়েছে বলে নতুন দিল্লির অভিযো'গ। নেপালের মতে, নতুন মানচিত্রর ভিত্তি হচ্ছে ১৮১৬ সালের সুগাউলি চুক্তি। কিন্তু ভারত সেই দাবি না'কচ করে দিয়ে আসছে।

মে মাসের মাঝামাঝিতে বিত'র্কিত ভূখণ্ড কালাপানি আর লিপুলেখকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নেপালের সরকার। অথচ ভারতের সব থেকে বন্ধু রাষ্ট্র বলে মনে করা হয় যাদের, তাদের মধ্যে নেপাল অন্যতম। কিন্তু তারাও ভারতের সঙ্গে একটা বিবা'দে জড়িয়ে পড়েছে।

"ভারত উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তবে চীন অনেক বেশি আগ্রা'সী,'' বলছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক কাকলি সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, ''যদি নেপালের নতুন মানচিত্র প্রকাশের ঘটনাটা দেখি, সেখানেও চীনের প্রভাব কাজ করে থাকতে পারে।'' বিশ্লেষকরা যেমন একদিকে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তাদের প্রভা'ব বিস্তারে সচেষ্ট হওয়ার কথা বলছেন, তেমনই ভারতের অভ্য'ন্তরীন রাজনীতিকেও দো'ষ দিচ্ছেন নিকটতম প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অব'নতির জন্য।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ পার্থসারথি ঘোষ বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বিদেশ নীতি নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর খুব একটা বক্তব্য বা দূরদৃষ্টি লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি বলেন, ''তিনি ২০১৪ সালে আগে বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু সে সবই ছিল তার সংগঠনের প্রচারের জন্য, হিন্দুত্ববাদের প্রচারের জন্য।" তিনি আরও বলছেন যে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরেও মোদী বিদেশ নীতি সংক্রা'ন্ত যা করেছেন, তারও বেশীরভাগটাই প্রচারসর্বস্ব।

পার্থসারথি বলছিলেন, "তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সব সার্ক দেশগুলির প্রধানদের আহ্বান জানালেন, নওয়াজ শরিফও এলেন। কিন্তু কাজের কথা কিছু এগুলো না। তারপর থেকে তিনি যতবারই বিদেশ সফরে গেছেন, সেগুলো যত না সেই সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করার জন্য, তার থেকে বেশি নিজের দেশের মানুষের কাছে প্রচারের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল বলেই আমার মনে হয়।"

এই সরকারের আমলেই বিশ্বের নানা রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে বহু বৈঠক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল সহ পৃথিবীর নানা দেশে গেছেন - আলোচনা হয়েছে, চুক্তি হয়েছে। মোদী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চীন সফর করেছেন পাঁচবার এবং ২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর চীনা নেতার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে তার বৈঠক হয়েছে অন্তত ১৮বার।

কিন্তু নিকটতম প্রতিবেশিদের কাছে কি ভারতের সম্পর্কে একটা নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে - দেশের ভেতরে উ'গ্র জাতীয়বাদী মনোভাব উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যান লাহিড়ীর কথায়, "যেসব আইন নানা সময়ে ভারতে পাশ করা হচ্ছে, সেগুলো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ভালভাবে নিচ্ছে না। আজকে বিশ্বায়নের যুগে উ'গ্র জাতীয়তাবাদ কিন্তু কখনই কাম্য নয়।

''আর ভারতের কাছে প্রতিবেশীরা এটা আশাও করে না। ভারত একটা সময়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দো'লনে ছিল, বর্ণবৈ'ষম্যের বি'রু'দ্ধে ল'ড়াই করেছে - সেরকম একটা দেশের কাছে প্রতিবেশীরা এধরনের উ'গ্র জাতীয়তাবাদী আইন আশা করে না," বলেন ইমন কল্যান লাহিড়ী।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন প্রতিটা দেশের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা চালাতে হবে ভারতকে। আর ভারতের সাধারণ মানুষ আর রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ যে ''যু'দ্ধং দেহি'' মনোভাব নিয়ে চলতে শুরু করেছেন, ভারতকে সেই সামরিক সমা'ধানের পথে না হেঁটে কাজে লাগাতে হবে কূটনীতিকে। সূত্র : বিবিসি বাংলা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে