আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত সপ্তাহে অনেকটা নীরবেই তেহরানে গিয়ে দিন কা'টিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তেহরানে নামেন মস্কোতে সাংহাই সহযোগিতা জোটের বৈঠকে যোগ দিতে যাওযার পথে। আর জয়শঙ্কর মস্কো থেকে ফেরার পথে মঙ্গলবার সারাদিন কা'টিয়েছেন তেহরানে।
নীরবে এই সফর নিয়ে সরকারিভাবে রিফুয়েলিং অর্থাৎ বিমানে তেল ভরার যু'ক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের দুই মন্ত্রী সেই তেল দুবাই বা আবুধাবিতে না ভরে তেহরানে কেন নামলেন? পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনও দ্বিম'ত নেই যে চিরশ'ত্রু চীন এবং হালে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরান যেভাবে ঘনি'ষ্ঠ হচ্ছে ভারত তাতে গভীর উ'দ্বিগ্ন।
দিল্লির জওহারলাল নেহেরু ইউনিভারসিটির (জেএনইউ) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ এ বিষয়ে বলেন, চীনের সঙ্গে ইরানের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা বাড়ছে। তিনি বলেন, “ভারতের কাছে ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। ভারত কোনওভাবেই তা খো'য়াতে চায় না।”
ভারতের কাছে ইরানের গুরুত্ব: অধ্যাপক ভরদোয়াজ বলেন, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢোকার জন্য ভারতের কাছে ইরানের গুরুত্ব বিশাল। সে কারণেই ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়নে ঘনি'ষ্ঠভাবে জড়িত হয়েছিল ভারত।
সেই সাথে তিনি বলেন, জ্বা'লানির জন্য এবং কাশ্মীর ইস্যুতে ইরানের মত প্রভাবশালী একটি মুসলিম দেশের কাছ থেকে রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য ভারত উদগ্রী'ব। কিন্তু এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে দ্রু'ত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতিতে ভারত ও ইরান যে ভিন্ন দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে তা স্প'ষ্ট।
বিশেষ করে যে দেশটি এখন ভারতের সবচেয়ে শ'ত্রু দেশে পরিণত হয়েছে সেই চীনের সাথে ইরানের যে ব্যাপক অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত ঘনি'ষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে, তা ভারতের কাছে দুঃস্ব'প্ন। তবে ইরান ও ভারতের মধ্যে দূরত্ব একদিনে তৈরি হয়নি।
গত ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ঘনি'ষ্ঠতা যত বেড়েছে, ইরানের সঙ্গে ততই দূরত্ব বেড়েছে। সেই শূন্যতা পূরণে ঝ'ড়ের মত ঢু'কে পড়েছে চীন।
চীন ও ইরানের চুক্তি: চীন এবং ইরান তাদের মধ্যে ২৫ বছরের একটি ‘কৌশলগত সহযোগিতার‘ চুক্তি নিয়ে বোঝাপ'ড়া চূ'ড়ান্ত করে ফে'লেছে বলে জানা গেছে।
নির্ভ'রযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত নানা ত'থ্যের ভি'ত্তিতে যা জানা গেছে এই চু'ক্তিতে ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরও কয়েক ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন আগামী ২৫ বছরে কমপক্ষে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইরানের যে বন্দ'রটির উন্নয়নের শুরু ভারতের হাতে হয়েছে সেই চাবাহার বন্দরের সম্প্রসারণ এবং ঐ বন্দরের সাথে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরের রেল যোগাযোগের কাজ এখন চীনের হাতে তুলে দেওয়ার কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে ইরান। শুধু তাই নয়, জানা গেছে চীন এখন চাবাহার বন্দরটিকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপেক) অংশ করতে উ'দগ্রীব।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক রাকেশ সুদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধা'জ্ঞার আশঙ্কায় চাবাহার বন্দর উন্নয়নে প্রতিশ্রু'তি পূরণে ভারতের গড়িমসিতে ইরান ক্ষু'ব্ধ। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে এশিয়ায় জোট রাজনীতির আমূল পরিবর্তনের প্র'ভাব।
রাকেশ সুদ বলেন, “মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে রাশিয়া এবং চীনের দৃষ্টিভ'ঙ্গি এখন একইরকম। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তান, ইরান এবং তুরস্ক। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যেসব দেশের সাথে ভারতের ঘনি'ষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে- সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব- তারা ইরানের বড় শ'ত্রু।”
পাকিস্তান ও ইরানের নতুন বন্ধুত্ব: পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের আগ্রহে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কে যেভাবে ঘনি'ষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে তা ভারতের জন্য বাড়তি মাথাব্য'থা। কারণ, ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে ভারত তাদের প্র'ভাব কতটা ধ'রে রাখতে পারবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেন্টারের আয়োজনে পাকিস্তান নিয়ে এক অনলাইন আলোচনায় সেদেশের প্রখ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, প্রধানত অর্থনৈতিক স্বার্থে ইরানের সাথে নতুন সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে পাকিস্তানের ভেতর আগ্রহ বাড়ছে।
তিনি বলেন, “সৌদি আরব দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের স্বার্থকে নতুন করে পর্যালোচনা করছে এবং পাকিস্তানের চাইতে ভারত তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই সাথে ইরান এখন পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
তাহলে ভারত কি তাদের একসময়কার ঘনিষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু দেশ ইরানকে একেবারেই হা'রিয়ে ফেলছে? অধ্যাপক ভরদোয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র না'খোশ হবে তা জেনেও দু’জন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে তেহরানে পাঠিয়ে ভারত বোঝাতে চেয়েছে যে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ককে তারা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। “ভারত বার্তা দিতে চাইছে যে পররাষ্ট্র নীতি এবং কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে দিল্লীর নীতি এখনও স্বাধীন। এ ব্যাপারে তারা আপোসহীন।”
তাছাড়া তিনি বলেন, ভারতের মত বড় একটি বাজার সবসময়ই ইরানের জন্য লোভনীয় এবং ইরান নিশ্চয়ই জানে যে তাদের জ্বা'লানি তেলের পুরোটাই চীন কিনবে না।
কিন্তু আমেরিকা এবং চীনের রে'ষারে'ষিকে কেন্দ্র করে এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে যে দ'লাদ'লি শুরু হয়েছে ভারত-ইরান সম্পর্ক যে তার বলি হচ্ছে, তা নিয়ে কোনও স'ন্দেহ নেই।