মঙ্গলবার, ০৬ অক্টোবর, ২০২০, ১২:১৭:৩০

যে সব কারণে আজারবাইজানকে সমর্থন দিচ্ছে না ইরান!

যে সব কারণে আজারবাইজানকে সমর্থন দিচ্ছে না ইরান!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আর্মেনিয়ার দ'খ'ল করে রাখা নাগরনো-কারাবাখ এবং এর পার্শ্ববর্তী সাতটি থানা দ'খ'লদার মু'ক্ত করতে আজারবাইজানী সেনাবা'হি'নী তাদের সর্বশক্তি দিয়ে যু'দ্ধ করছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা স্বাধীন করছে। দিন যতই যাচ্ছে এই যু'দ্ধে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের ভূমিকা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। 

তুরস্ক, পাকিস্তান, ফ্রান্সসহ অনেক দেশ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কিন্তু এ অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ইরান এখন তার অবস্থান পরিষ্কার করেনি। আজারবাইজানের পক্ষে বা আর্মেনিয়ার বি'রু'দ্ধে কোনও বক্তব্য তেহরান থেকে আসেনি। অথচ স্বাভাবিক ভাবে সকলের প্রত্যাশা ছিল ইরান তুরস্কের মত আজারবাইজানের পক্ষ না নিলেও অন্তত আর্মেনিয়ার অ'বৈ'ধ দ'খ'লদারিত্ব আর নি'রী'হ মানুষ হ'ত্যাকে নি'ন্দা করবে। কিন্তু তাও করেনি। 

এমনকি ইরানি মিডিয়াও আজারবাইজানের পক্ষে আওয়াজ তুলছে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে ইরান কি তাহলে আর্মেনিয়ার পক্ষে? যদি তাই হয় তবে কেন? ইরানের পরে আজারবাইজানই একমাত্র দেশ যার জনসংখ্যার শতকরা হারে সবচেয়ে বেশি লোক শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী। দেশটির ১ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ ভাগেরও বেশি মানুষ শিয়া। এদিক থেকে চিন্তা করলে ইরানের স্বাভাবিক ভাবেই আজারবাইজানের পক্ষ নেওয়া উচিত বলে মনে হবে। 

তাছাড়াও যে ইরান তার তথাকথিত শিয়া মতাদর্শ প্রচারের জন্য মধ্য প্রাচ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে সে কেন এই ক্রা'ন্তিকালে আজারবাইজানের পাশে দাঁড়াবে না? শুধুমাত্র যদি ধর্মীয় দিক থেকেও চিন্তা করা হয় তাহলেও প্রশ্ন জাগে যে ইরান ইসলামী প্রজাতন্ত্র নামের দেশটি মুসলিম অধ্যুষিত আজারবাইজানকে রেখে কেন ক'ট্ট'র খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আর্মেনিয়ার পক্ষে?

আর এটা ঘ'টলো এমন একটি যু'দ্ধে যাকে আর্মেনিয়া ''পবিত্র ভূমি'' র'ক্ষার ল'ড়া'ই বলে ঘোষণা দিয়েছে। খ্রিস্টান একটি রাষ্ট্রের 'পবিত্র' এই ল'ড়া'ইয়ে 'ইসলামী প্রজাতন্ত্রের' সমর্থন! কেমন একটা খ'টকার বিষয় না? ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভা'ব বিস্তার করার জন্য হাতে যতগুলো ট্রাম্পকার্ড ছিল সবই ব্যাবহার করেছে। কখনও ইসলামের বি'প্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে, কখনো শিয়া মতাদর্শের উ'ত্থা'ন দেখিয়ে, আর কখনোবা ইসরাইল-আমেরিকার বি'রু'দ্ধে ফাঁকা বুলি আওরিয়ে। কিন্তু ইরানের ন'গ্ন বিলাস ফুটে উঠেছে সিরিয়া এবং ইয়েমেনের যু'দ্ধে।

আর এখন আজারবাইজানে ইরান দেখিয়েছে তার রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী জনপদে গণহ'ত্যাকেও সে নীরবে সমর্থন দিতে কু'ণ্ঠাবো'ধ করে না। এবার আসি কেন- এর উত্তরে। ইরান এই যু'দ্ধে আজারবাইজানকে সমর্থন না দেওয়ার পিছেন আছে মূলত অভ্যা'ন্তরিন এবং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক এবং কৌ'শলগত হিসাব নি'কা'শ। ভূরাজনৈতিক পরি'স্থিতি ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে আজারবাইজানের স্বাধীনতার ঘোষণার দেড় মাসের মধ্যেই তখনকার ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আকবর ভিলায়েতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকু সফর করে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চু'ক্তি সই করেন।

চু'ক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সা'মরিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জো'রদার করা এবং আজারবাইজানকে ওআইসির সদস্যপদ পেতে আন্তর্জাতিক সহয়তা দেওয়া। ভিলায়েতি দেশে ফিরে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই ৪ জানুয়ারী ১৯৯২ তারিখে ইরান আজারবাইজানকে স্বী'কৃতি দেয়। ইরানের তখন ইচ্ছা ও ধা'রণা ছিল আজারবাইজান নিকট ভবিষ্যতে ইরান ধাঁচের একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কিন্তু নতুন এই রাষ্ট্রটি গঠনের প্রথম সরকার মাত্র কয়েক মাস ক্ষ'মতায় ছিল। 

ওই বছরই জুন মাসের নির্বাচনে জয়ী হন প্যান-তুর্কী এবং প্যান-আজেরি হিসেবে পরিচিত আব্দুলফায এলচিবেই। নতুন এই প্রেসিডেন্ট তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ঘ'নি'ষ্ঠ করার প্রতি জো'র দেন। তিনি বৃহত্তর আজারবাইজান গঠনেরও ঘোষণা দেন। বৃহত্তর আজারবাইজান বলতে বর্তমানের স্বাধীন আজারবাইজান রাষ্ট্র এবং ইরানের উত্তরাঞ্চলের আজেরি-তুর্কী জনগোষ্ঠী আধ্যুসিত ইরানী-আজারবাইজান নামে পরিচিত অঞ্চলকে বুঝায়।

১৮২৮ সালে তুর্কমেন চাই নামক চু'ক্তির মাধ্যমে আজারবাইজানের এই অংশটিকে ইরানের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়। আব্দুলফায এলচিবেই-এর ঘোষণা তখন ইরান সরকারকে বিচ'লিত করে। আজারবাইজান শ'ক্তিশালী হলে ইরানের এই উত্তরপূর্বাঞ্চলটিতে বসবাসরত প্রায় দেড় কোটি আজেরি-তুর্কিরা স্বাধীনতা চাইতে পারে অথবা আজারবাইজানের সাথে একী'ভূত হতে পারে। সুতরাং শ'ক্তিশালী এক আজারবাইজান ইরানের জন্য হু'ম'কিস্ব'রূপ। তাই তেহরান কখনই বাকুকে শ'ক্তিশা'লী দেখতে চায়নি।

আর আজারবাইজানকে দু'র্ব'ল রাখতে সবচেয়ে মো'ক্ষম অ'স্ত্র হচ্ছে নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চলের অশান্তি বিরা'জমান রাখা। একারনেই ১৯৯২ সালে শুরু হয়ে ১৯৯৪ সালে এসে ভ'ঙ্গুর শান্তি চু'ক্তি করা পর্যন্ত চলা আর্মেনীয় দ'খ'লদারি হা'মলার সময় ইরান আর্মেনিয়ার পক্ষ নিয়েছিল আজারবাইজানকে এক'হাত দেখিয়ে দিতে। এর পরে কখনও প্রত্যক্ষ কখনও বা পরখভাবে ইরান আর্মেনিয়াকে সাপো'র্ট দিয়েই গেছে।

সেক্যুলার মতাদর্শ বনাম শিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্ব'ন্দ্ব আজারবাইজানের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ মুসলমান। এদের ৮৫ ভাগ শিয়া এবং ১৫ ভাগ সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু আজারবাইজান রাষ্ট্রীয় ভাবে তুরস্কের মত সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী। আজারবাইজান ছাড়া কোনও শিয়া সংখ্যাগ'রিষ্ঠ দেশই সেক্যুলার না। এরকম শিয়া জনগোষ্ঠীর সেক্যুলার একটি দেশ যদি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাম'রিক দিক দিয়ে শ'ক্তিশালী হয় তবে তা ইরানি মোল্লাদের শা'সনের সিংহাসন ন'ড়ব'ড়ে করে দিতে পারে। 

ধর্মভিত্তিক শিয়া রাষ্ট্রের ধা'রনায় ঘু'ণ ধ'রাতে পারে। এ কারণেও ইরান শ'ক্তিশালী আজারবাইজানের পথে কা'টা হয়ে দাঁড়াবে। ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ইরানের উত্তরপুরবাঞ্চলীয় আজারবাইজান নামক এলাকাটিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বি'ক্ষো'ভ হয়েছে। ওখানকার আজেরি-তুর্কী জাতি পারসিকদের পরেই ইরানের বৃহত্তম জাতিগত গোষ্ঠী এবং মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরও বেশি।

ইরান সরকার কখনই এই গোষ্ঠীটিকে মাথাচ'ড়া উঠতে দেয়নি। তাই যখনই ওই এলাকায় বিক্ষো'ভ হয় ইরান তা শ'ক্ত হাতে দ'ম'ন করে। এবারও ওই এলাকাতে এবং আরও কিছু এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তুর্কিরা ইরান সরকারের আজারবাইজান-বিরো'ধী আবস্থানের বি'রু'দ্ধে বি'ক্ষো'ভ করছে। কিন্তু তেহরান সরকার তাদের কাছে মাথা নত করার নয়। রাশিয়া ফ্যাক্টর মধ্যপ্রাচ্যে ইরান রাশিয়া একে অপরের সম্পূরক শক্তি।

আমেরিকা এবং ইউরোপের আবরো'ধ আর ইসরাইলের হু'মকি ধা'মকির বি'রু'দ্ধে ইরানের সবচেয়ে বিশ্ব'স্ত বন্ধু রাশিয়া। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা শ'ক্তিকে রু'খতে আর ভূমধ্যসাগর এবং ভারত মহাসাগরে নামার জন্য ইরানকে ছাড়া রাশিয়ার কোনও উপায় নেই। তাই তারা অনেক আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রায় একই বলয়ে আবস্থান করছে। যেমনটি দেখা গেছে সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং লিবিয়াতে। আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক অনেক পুরাতন। আর্মেনিয়াকে রাশিয়া তার পশ্চাৎ বাগিচা হিসেবে দেখে।

দু'দেশের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাম'রিক এবং প্রতির'ক্ষা চু'ক্তি আছে। এই চু'ক্তির কারণে আর্মেনিয়াতে আ'ক্র'মণ হলে রাশিয়া সর্বশক্তি দিয়ে আর্মেনিয়াকে সাহায্য করতে বাধ্য। এক্ষেত্রে ইরান রাশিয়ার বি'রু'দ্ধে গিয়ে আজারবাইজানের পক্ষ নিতে পারে না। তুরস্ক ইস্যু তুরস্কের সাথে ইরানের সম্পর্ক সবসময়ই ছিল ঢিলে ঢালা। অন্যদের চা'পে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আঙ্কারা ও তেহরান একে অপরকে সহযোগিতা করত। কিন্তু এই সম্পর্ক কখনই দহরম মহরম ছিলনা। 

একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলেই আবার শুরু করে দিত ঠো'করা-ঠু'করি। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের উ'ত্থানের কারণে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে কিছুটা কো'ণঠা'সা হয়ে পড়ে। আর সিরিয়াতে আঙ্কারা এবং তেহরান পরস্পর বিরো'ধী অবস্থান দু'দেশের সম্পর্কে একেবারে খা'দের কিনারে নিয়ে গিয়েছিল। ফিলিস্তিনেও তুরস্ক ইরানের একক কর্তৃত্বে হাত দিয়েছে।

ইরাক, লেবানন, লিবিয়াতে ইরানের সুখের ঘর ভে'ঙ্গে দিয়ে তুরস্ক তেহরানকে যে চা'পে রেখেছে তাতে তুরস্কের হাত শ'ক্তিশা'লী হোক এমন কোনও পরিক'ল্পনা ইরান সফল হতে দিবে না। সুতরাং আজারবাইজান শ'ক্তিশালী হলে তুরস্ক ককেশাশীয় অঞ্চলে নিজের অবস্থানকে আরও দৃ'ঢ় করতে সক্ষম হবে। যা ইরানের জন্য রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষ'তির কারণ। ইসরাইল ফ্যাক্টর ইরান এবং ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যসহ সব ক্ষেত্রেই আবস্থান করেছে পরস্পর বিরো'ধী মেরুতে। 

সেক্ষেত্রে আজারবাইজান আর ইসরাইলের সখ্যতা ইরানের সহ্য না হওয়ারই কথা। বিশেষ করে গত কয়েক দশক ধ'রে আজারবাইজান ইসরাইলের কাছ থেকে যেভাবে অ'স্ত্র কিনে তার সামরিক শ'ক্তি বৃদ্ধি করেছে তাতে স্বভাবগত কারণেই ইরান ইসরাইলের বি'রু'দ্ধে তথা আজারবাইজানের বি'রু'দ্ধে দাঁড়াবে। এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আজারবাইজান ইস্যুতে ইরান শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে বা আবে'গেতা'ড়িত হয়ে নয় বরং অনেক বিস্তৃত পরিসরে এবং বহুমাত্রিক হিসাবনি'কাশ করেই খেলছে। লেখক: সরোয়ার আলম, তুরস্ক থেকে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে