সোমবার, ০৯ নভেম্বর, ২০২০, ০৮:১৯:৩৫

জো বাইডেন যখন ক্ষমতায় এলেন, এরদোগান এখন কী করবেন!

জো বাইডেন যখন ক্ষমতায় এলেন, এরদোগান এখন কী করবেন!

ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক : নিকট অতীতে হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা পরিবর্তনে বিশ্বময় এতটা আলোড়ন ও উদ্বেগ দেখা যায়নি। সম্ভবত রাজনৈতিক পটভূমিবিহীন এক প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক রাষ্ট্রপতিদের সারিতে প্রবেশের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন, তেমনই দুনিয়াবাসীর জন্য ছিল ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। 

প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেপুটি জো বাইডেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় পৃথিবীর নানা অঞ্চলে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে এক প্রকার শীতল আত'ঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিংবা বলা যায়, অনেকে আত'ঙ্কিত হওয়ার ভান ধরেছে। সত'র্ক দেশগুলোর মাঝে একদিকে রয়েছে দুই মিত্র স্বৈরতান্ত্রিক মিসর ও রাজতান্ত্রিক সৌদি আরব। অপরদিকে রয়েছে তুরস্ক। মিসর-সৌদির প্রসঙ্গ আপাতত না করলেও বাইডেনকে নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগের কারণ কী?

বাইডেনকে নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগের যৌক্তিক কারণ আছে। ওবামা আমলে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল সিরিয়া ইস্যু। সিরিয়ায় আরব বসন্তের সূচনায় তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু আইএস প্রাদুর্ভূত হলে আমেরিকা কুর্দিদের ব্যবহার করে। 

ওদিকে কুর্দি সশস্ত্র দল পিকেকে তুরস্কের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী দল হিসেবে বিবেচিত। তুরস্কের গভীর প্রতীতি, ২০১৬ সালের ব্যর্থ ক্যু-প্রচেষ্টার নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল। তাছাড়া ওবামা আমলের শেষদিকে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলসহ তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে কুর্দি সশস্ত্র দলের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের পেছনেও সিআইএর হাত রয়েছে বলে তুরস্ক মনে করে।

ট্রাম্প আমলে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নত হয়, উষ্ণ না হলেও ওয়ার্কিং রিলেশন প্রতিষ্ঠা হয়। তাই উত্তর সিরিয়ায় পিকেকে বিরোধী তুর্কি অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর বাধা প্রদান করেনি। যদিও রাশিয়া হতে এস-৪০০ কেনা নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। তবুও কংগ্রেসের চাপ সত্ত্বেও ট্রাম্প তুরস্কের ওপর এই ইস্যুতে কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি।

ট্রাম্পের পর ওবামা প্রশাসনের দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রেসিডেন্টের আসনে উপবেশন করায় বিরোধের স্মৃতিকারতা ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রবল। বাইডেন তা গোপন করেননি। তিনি এরদোগানকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনার কথা বলেছেন (যদিও প্রায় বছরখানেক আগের বক্তব্য)। এজন্য কুর্দি দলসহ বিরোধীদের শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। 

আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের সমালোচনাও করেছেন তিনি। নাগরনো কারাবাখের যুদ্ধে প্রকাশ্যে আজারবাইজানকে সমর্থন ও ভূমধ্যসাগরে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ প্রশ্নে গ্রিসের সাথে দ্বন্দ্ব জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে বাইডেন তুরস্কের সমালোচনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাইডেন হয়ত প্রকাশ্যে পূর্বের ভাষায় কথা বলবেন না। কিন্তু তার পররাষ্ট্র এজেন্ডায় এরদোগানকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা যে থাকবে, তা নিশ্চয় করে বলা যায়। 

এক সূত্রে জানা গেছে, তুরস্ক হবে তার ৭ম পররাষ্ট্র এজেন্ডা। আগামী মার্চের দিকে এ পলিসির বাস্তবায়ন দেখা যেতে পারে। মার্কিন প্রশাসনের তুর্কিবিরোধী বহু লোক আছে, বিশেষত কংগ্রেসে। হাউসের চাপ এতদিন অগ্রাহ্য করে তুরস্ককে সহায়তা করেছেন ট্রাম্প। এখন কংগ্রেসের সঙ্গে হোয়াইট হাউসও যদি মিলে যায়, তুরস্কের পক্ষে কথা বলার জন্য খুব কম লোকই পাওয়া যাবে মার্কিন প্রশাসনে।

যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্কের বিরোধের হেতুগুলো পর্যালোচনা করলে মনে হবে ওগুলো তুচ্ছ। বাস্তবেও তাই। নেপথ্য কারণ ভিন্ন। বহু বছর ধরে তুরস্ক এতটা স্বাধীনতা চর্চা করেনি। এরদোগান এখন স্বাধীনতার পাশাপাশি বহির্মুখীতা চর্চা করছেন। এমন এক স্বাধীন শাসক ইউরোপ ও এশিয়ায় বিস্তৃত একটি দেশ শাসন করবেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়।

বাইডেন এক বছর আগে যা বলেছেন, তা কি করবেন? নিষেধাজ্ঞা আরোপ, কুর্দিদের সশস্ত্র কার্যক্রমে সহযোগিতা, বিরোধীদের শক্তিশালী করে এরদোগানকে সরিয়ে দেয়া? কিছু অ্যাকশন নিতে পারেন, যেমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ। ট্রাম্পের আমলেও কিছু তুর্কি পণ্যের ওপর কর বাড়ানো হয়েছিল। এ ধরনের টোটকা পদক্ষেপ নিতেই পারেন। কিন্তু তুরস্কে রেজিম পরিবর্তনের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন কি বাইডেন? 

তার আগে তিনি নিশ্চয়ই বহুবার ভাববেন। তুরস্কে ক্যু চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। দেশটি ইরাক বা লিবিয়ার মত নয়। ন্যাটো সদস্য তুরস্ক কিছুটা রাশিয়ামুখী। বাইডেন কি এমন পদক্ষেপ নেবেন, যাতে তুরস্কের রাশিয়া অভিমুখে যাত্রা আরও গতি পায়? মানবাধিকার হরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকোচন, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও গণতন্ত্রের হত্যার মতো যেসব বাহ্যিক অভিযোগে সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র কোন দেশের সরকার সরিয়ে দেয়, এমন অভিযোগ মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক দেশের বিরুদ্ধে উত্থাপন করা যায়। 

বাইডেন নিজেই সাংবাদিক খাশোগি হত্যার জন্য এমবিএসকে শাস্তি দেয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি কি ওই দেশগুলোতে রেজিম পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন? সময়ের পরিক্রমায় এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। তবে এটুকু বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে যে নগ্ন দ্বিচারিতা আছে বাইডেনের আমলে তা দূরীভুত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। লেখক:  ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক, অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে