শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ০৮:২৫:০৯

ভারতে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে দেখা করায় কারাগারে মুসলিম কিশোর

ভারতে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে দেখা করায় কারাগারে মুসলিম কিশোর

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সাকিব ও তার ১৬ বছর বয়সী সাবেক এক হিন্দু সহপাঠিনীর সাথে ১৪ই ডিসেম্বর বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছিল। একসাথে পিৎজা, সফট ড্রিংকস খাওয়া ও খানিকটা হাঁটাহাঁটি করা, এই ছিল তাদের ঘোরাঘুরি। কিন্তু তাদের ঘুরাঘুরি শেষ হওয়ার আগেই তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সাকিবকে পাঠানো হয় জেলে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, সে মেয়েটিকে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করছিল।

ভারতের বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশে সম্প্রতি 'ধর্মান্তর-বিরোধী' আইন নামে একটি বিতর্কিত আইন পাশ হয়েছে। এই আইনের নতুন শিকার এই দুই কিশোর-কিশোরী। উত্তর প্রদেশে 'অবৈধ ধর্মান্তর' ও 'কেবলমাত্র ধর্মান্তরের উদ্দেশ্যে কোনো ভিনধর্মী মেয়েকে বিয়ে করা' ঠেকাতে গত ২৯শে নভেম্বর থেকে 'দ্য উত্তর প্রদেশ প্রহিবিশন অব আনলফুল কনভার্শন অব রেলিজিয়ন অর্ডিন্যান্স, ২০২০' নামে একটি আইন চালু হয়। এই আইনে সর্বোচ্চ ১০ বছর সাজা হওয়ার বিধান রয়েছে।

তবে এখন পর্যন্ত আইনটির মাধ্যমে কেবল মুসলিম ছেলেদেরই টার্গেট করা হচ্ছে। ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতারা অভিযোগ করেছেন, প্রেমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুসলিম ছেলেরা হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরিত করার গোপন ষড়যন্ত্র করছে। এ ষড়যন্ত্র থামাতেই নতুন এই বিতর্কিত আইন চালু করা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যটিতে। সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটিকে তার সাথে পালিয়ে বিয়ে করার জন্য 'প্ররোচিত' করছিলেন। এরপর তাকে তার ধর্ম পাল্টাতে বাধ্য করতেন। 

বলা হয়েছে, মেয়েটির বাবার করা এক অভিযোগে উপর ভিত্তি করে সাকিবর বিরুদ্ধে এমন এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু খোদ মেয়ের বাবাই পাল্টা অভিযোগ করেছেন যে, স্থানীয় পুলিশ এসে নিজেরাই তার হয়ে অভিযোগ লিখে নিয়েছে! পাশাপাশি পুরো বিষয়টি নিয়ে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করেছে। তার মেয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল এমন অভিযোগও জোর গলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। পাশাপাশি, ওই মেয়েও জানিয়েছে, সাকিব তার সঙ্গে কখনোই প্রেম, বিয়ে বা ধর্মান্তর নিয়ে আলাপ করেনি।

এছাড়াও ঘটনাটিতে আরো কিছু সমস্যা রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সাকিবর বয়স ১৮ বছর। কিন্তু তার পরিবারের দাবি সে আরও কম বয়সী, অর্থাৎ, অপ্রাপ্তবয়স্ক। দলিত মেয়েটিইর বক্তব্য অনুসারে, ১৪ই ডিসেম্বর রাত ১১টার দিকে নিজ বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে নাসিরপুর সাকিবের সঙ্গে দেখা করতে যায় সে। সেখানে মাঝরাতে একসঙ্গে পিৎজা খায় তারা।

নাসিরপুর গ্রামের প্রধান মনোজ কুমার জানান, স্থানীয়রা তাদের ঘোরাঘুরি করতে দেখলে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করে। এমন সময় তারা দুজন দুই দিকে পালায়। স্থানীয়রা পরবর্তীতে মেয়েটিকে ধরে ফেলে। তাকে তার বাবা ও সাকিবকে ডেকে আনতে বলে। তারা আসলে সাকিব ও মেয়েটিকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। মেয়ের দাবি, সাকিব চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত তার সহপাঠী ছিল। দুই মাস আগে তাদের আবার যোগাযোগ হয়। এরপর থেকেই কথা চলতে থাকে তাদের মধ্যে।

এদিকে, সাকিবের পিতা-মাতার অভিযোগ, সাকিব মুসলিম বলেই তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার মা সানজিদা জানান, তার ছেলের বয়স ১৭ বছর। কিন্তু তা প্রমাণের জন্য বাড়িতে কোনো নথিপত্র নেই তাদের কাছে। তবে কিরারখেদি গ্রামের প্রধান জানান, তারা স্কুল থেকে নথিপত্র জোগাড়ের চেষ্টা করছেন যাতে সাকিবের বয়স প্রমাণ করা যায়। এছাড়া, সাকিবর বোন সাবিনা জানান, দলিত মেয়েটি সাকিবর সঙ্গে দেখা করতে তাদের গ্রামে গিয়েছিল। মেয়েটি জানতো যে, সাকিব একজন মুসলিম।

অবৈধ ধর্মান্তরকরণ আইন ছাড়াও, অপহরণ ও তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি (নীপিড়ন প্রতিরোধ) আইন এবং যৌন নির্যাতন থেকে শিশুদের সুরক্ষা (পসকো) আইনেও সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও মেয়ের বাবার দায়ের করা অভিযোগপত্রে কোনো যৌন নির্যাতনের কথা উল্লেখ নেই। তারপরও পুলিশ মেয়েটির বয়স টেনে দাবি করেছে, সাকিবের উদ্দেশ্য ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটির যৌন নিপীড়ন করা।

সাকিবর বিরুদ্ধে বিতর্কিত ধর্মান্তরকরণ বিষয়ক আইনে অভিযোগ আনা হলেও, মেয়ের বাবা জানান, আদতে এমন কিছু করার মতো কিছুই ঘটেনি। দ্য প্রিন্টকে দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, আমি তাদের (পুলিশ) বলেছি যে, তারা কেবলই ঘুরতে গেছে ও মেয়েটি ভুল করেছে। কিন্তু পুলিশ ও গণমাধ্যম এটিকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা বানিয়ে দিয়েছে। আমি পুলিশকে বলেছিলাম যে, আমি অভিযোগ দায়ের করতে চাই না। কিন্তু তারা আমায় ধমকেছে ও বলেছে যে, ভবিষ্যতে তারা পালিয়ে যেতে পারে। 

তিনি আরও বলেন, 'আমার মেয়ের ভালোর জন্যই আমার অভিযোগ দায়ের করা উচিৎ। আমি এতকিছু বুঝিনি, তাই রাজি হয়েছি।' তার নামে দায়ের করা অভিযোগপত্রে লেখা হয়েছে, 'সাকিব আমার মেয়েকে তার সঙ্গে পালানোর জন্য প্ররোচিত করেছে। আমার মেয়েকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্য ছিল তার।' কিন্তু ওই কৃষক পিতা জানান, তিনি এমন কিছুই পুলিশকে বলেননি।

দ্য প্রিন্টকে তিনি বলেন, সাকিব কখনোই আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে বা ধর্মান্তর নিয়ে কথা বলেনি। আমি আমার অভিযোগে এমনটা বলবো কেন? হয়তো তার উদ্দেশ্য এমনটাই ছিল, আমি জানি না। সে কেবল তার নামটা নিয়ে আমাদের কাছে মিথ্যা বলেছে। সে আমার মেয়ের কাছে জানায়নি যে, সে মুসলিম। কিন্তু সে কখনোই বিয়ে বা ধর্মান্তর নিয়ে আমার মেয়ের সাথে কথা বলেনি। আমি এসব লিখিনি।

মেয়েটিও জানিয়েছে, সাকিব তাকে বিয়ে বা ধর্মান্তরের কথা বলেনি। সে জানায়, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেও সে একই বক্তব্য দিয়েছে। কিন্তু পুলিশকর্মী অজয় কুমার আগারওয়াল জানান, মেয়েটি ইচ্ছাকৃতভাবে সাকিবর সঙ্গে ঘুরতে গেলেও এটা অপহরণ হিসেবেই বিবেচিত হবে, কারণ সে অপ্রাপ্তবয়স্ক। এসব ঘটনায় আমরা ধরে নেই যে, আসামী অপরাধের উদ্দেশ্য নিয়েই অপ্রাপ্তবয়স্ককে নিয়ে গেছে। এখানে মেয়ে কী বলছে তার গুরুত্ব নেই। এমনকি, মেয়ের বাবার হয়ে অভিযোগ লেখার কথাও অস্বীকার করেছেন আগারওয়াল। সূত্র : দ্য প্রিন্ট

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে