শনিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২১, ১১:৩২:৪৪

মিয়ানমার নিয়ে চীনা সমর্থনের নেপথ্যে নানামুখী সমীকরণ

মিয়ানমার নিয়ে চীনা সমর্থনের নেপথ্যে নানামুখী সমীকরণ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়ার উদ্যোগ চীন ও রাশিয়া আটকে দেবে, এমনটি বিশ্লেষকদের ধারণাতেই ছিল। চীন রাজি না হওয়ায় গত তিন বছরে নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব ওঠেনি। এমনকি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইসিজে) অন্তর্বর্তী আদেশ বাস্তবায়ন নিয়েও নিরাপত্তা পরিষদ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

সেই বাস্তবতায় গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ২ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক হলেও তার ফলাফল নিয়ে বিশ্লেষকরা শঙ্কায় ছিলেন। সেদিন বৈঠকের পর খবর ছিল, চীন, রাশিয়া রাজি না হওয়ায় এখনই কোনো বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে না। এর দুই দিনের মাথায় মিয়ানমার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

বিবিসি নিউজের কূটনৈতিক সংবাদদাতা জেমস ল্যান্ডেল গত বৃহস্পতিবার রাতে এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ''আশ্চর্যজনক। মিয়ানমার পরিস্থিতিতে 'গভীর উদ্বেগ', বন্দিদের মুক্তি দাবি ও গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জানিয়ে যুক্তরাজ্যের তৈরি করা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতির ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়া 'ভেটো' দেয়নি। 'ক্যু' শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। কূটনীতিকরা বলছেন, গত ১০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে মিয়ানমারের রাজনীতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের এটিই প্রথম যৌথ বিবৃতি।''

জাতিসংঘ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক আশীষ প্রধান বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থানের কথা বিবৃতিতে সরাসরি উল্লেখ করা না হলেও গত তিন বছরে মিয়ানমার নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এটিই প্রথম বিবৃতি। এই বিবৃতি দেওয়া নিয়ে আলোচনায় পক্ষে-বিপক্ষে সমতা ছিল না। তবে চীন তুলনামূলক কম একঘরে ছিল। কারণ বিবৃতির ব্যাপারে আরো কারো কারো অনীহা ছিল। বিবৃতি দেওয়ার পর এখন মিয়ানমারের ওপর নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ। 

তিনি বলেন, গত সপ্তাহে মিয়ানমার ও ইথিওপিয়ার টাইগ্রে ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রুদ্ধদ্বার আলোচনায় সবচেয়ে সোচ্চার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন এরই মধ্যে গণতন্ত্র ও মানবিক সহায়তাকে জাতিসংঘে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডাব্লিউ) নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে 'গভীর উদ্বেগ', সব বন্দির 'অনতিবিলম্বে মুক্তি' এবং সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর থেকে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের দাবিসংবলিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে চীন ও রাশিয়ার সমর্থনের অর্থ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আরো একঘরে হয়ে পড়েছে।

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য বহির্বিশ্বের প্রথম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। গত সোমবার মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের খবর পাওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় না ফিরলে মিয়ানমারের ওপর আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এরই মধ্যে মিয়ানমারে সু চির সরকার উৎখাতকে 'ক্যু' হিসেবে অভিহিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে তার সহযোগিতা কর্মসূচি পর্যালোচনা করছে।

জো বাইডেন গত বৃহস্পতিবার রাতে (ওয়াশিংটন ডিসি সময় দুপুরে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে বক্তব্য দেওয়ার সময়ও মিয়ানমারের প্রসঙ্গ টানেন। তিনি বলেন, ''বার্মায় (মিয়ানমারে) সামরিক অভ্যুত্থান মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ করতে কয়েক দিন ধরে আমরা আমাদের মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছি। বার্মা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের উদ্বেগ জানাতে আমি সিনেট নেতা ম্যাককনেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি এবং এ বিষয়ে কাজ করছি।''

তিনি আরো বলেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ফলাফল মুছে দেওয়ার চেষ্টা বা জনগণের ইচ্ছা পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা কোনো বাহিনীরই কখনো করা উচিত নয়। মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের কঠোর অবস্থান নিরাপত্তা পরিষদে চীনের অবস্থান পাল্টাতে ভূমিকা রেখেছে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। তবে চীনও চাচ্ছে মিয়ানমার পরিস্থিতির সমর্থনদাতা হিসেবে তাকে যেন কেউ চিহ্নিত করতে না পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, মিয়ানমার নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতিতে চীনের সমর্থনের মধ্য দিয়ে চীনা অবস্থান কতটা বদলেছে তা বুঝতে আরো সময় লাগবে। মিয়ানমারের ওপর চাপ কমানোর জন্য এটি 'আইওয়াশ' ও হতে পারে। লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, মিয়ানমার ও এর সামরিক বাহিনীর প্রতি চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের জন্য চীনের ওপর থেকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্যও বেইজিং নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়ে থাকতে পারে। 

পশ্চিমাদের কাছে অং সান সু চি গণতন্ত্রের প্রতীক হলেও মিয়ানমারে বেশির ভাগ ক্ষমতা সংবিধান অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর হাতে। চীন চাইছে, মিয়ানমারে সংবিধান সমুন্নত থাকুক। সু চি মুক্তি পেলেও বর্তমান সংবিধানে মিয়ানমারে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরবে না। যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী বিশেষজ্ঞ মং জার্নি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, অং সান সু চি গণতান্ত্রিক প্রতিটি চাতুর্যে সামরিক জেনারেলদের হারিয়েছেন। 

দ্বিতীয়ত, অভ্যুত্থানকারীরা রোহিঙ্গা জেনোসাইডের অভিযোগে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিচারের মুখে পড়ার ঝুঁকিতে আছেন। তৃতীয়ত, ট্রাম্পের আমলে এবং চীন, রাশিয়া ও ভারতের পরিস্থিতি জেনারেলদের আরো সাহসী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ মনে করছে, মিয়ানমারের জেনারেলদের সামনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, অতীতে মিয়ানমারে সামরিক সরকারগুলোর আমলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হলে এবার কেন নয়?

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমার বাহিনী যোগাযোগ করছে—এমন খবরও পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন রেস্টলেস বিয়িংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মাবরুর আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় লন্ডন থেকে বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে জনসংযোগ চালাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গাদের স্থানীয় আইন মেনে চলতে বলেছেন। মসজিদের জন্য তারা অর্থও দিয়েছেন।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে