শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২১, ১০:২৫:৩৮

জান্তা সরকারের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও চেয়ার-টেবিল-ডেস্ক ছেড়ে আন্দোলনে সরকারি কর্মচারীরা

জান্তা সরকারের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও চেয়ার-টেবিল-ডেস্ক ছেড়ে আন্দোলনে সরকারি কর্মচারীরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সেনা আতঙ্কে ভীতসন্ত্রস্ত মিয়ানমারের এবার নতুন চেহারা দেখছে বিশ্ব। দুঃসাহসী মিয়ানমার। ভয় নেই, পরোয়া নেই। ঘাড় গুঁজে চোখ বুজে থাকার দিন শেষ। রুখে দাঁড়িয়েছে মিয়ানমার। ফুঁসছে ইয়াঙ্গুন, গর্জে উঠছে নেপিদো। দিন ঘুরলেই ভারি হচ্ছে কাচিন, ডাওয়েই, মান্দালয়ের রাজপথ। থমকে গেছে সরকারি কার্যক্রম। সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রুখে দাঁড়ান দেশটির সরকারি কর্মচারীরা। জান্তা সরকারের হুমকি ও ঊর্ধ্বতনদের চাকরিচ্যুতির হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও চেয়ার-টেবিল-ডেস্ক ছেড়ে আন্দোলনে নামেন সরকারি কর্মচারীরা। দিন যাচ্ছে, এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। শুরুর দিন থেকে প্রতিদিনই একটু একটু করে খালি হচ্ছে দেশটির সরকারি দপ্তরগুলো। প্রায় প্রতিদিনই ১০০/২০০/৫০ জন করে ফাঁকা হচ্ছে সরকারের প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের চেয়ার। গত ৭ দিনে কয়েক হাজার ছুঁয়েছে অবাধ্য কর্মীর সংখ্যা। এ হারে চললে লাখ ছাড়িয়ে যাবে সামনের দিনগুলোতে। 

ভয়ে নড়েচড়ে বসেছে খোদ জান্তা সরকারও। আন্দোলন বন্ধ করে কাজে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল মিন অং হ্লাইং। বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ নিয়ে এক বক্তব্যে সরকারি কর্মচারীদের এ হুঁশিয়ারি দেন তিনি। বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের কাজ জনগণের সেবা করা। তাদের রাজনীতিতে অংশ নেয়া নিষিদ্ধ। এটা করলে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। অসহযোগ আন্দোলনকে ‘অসাধু ও দুষ্ট ব্যক্তি’ দ্বারা সৃষ্ট হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। সেনা সরকারের তথ্য সেবা কার্যালয় থেকে ইস্যু করা ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘যারা তাদের দায়িত্ব থেকে দূরে আছেন, অনুরোধ করছি তারা যেন আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অবিলম্বে কাজে ফেরেন।’ জমায়েত এড়িয়ে চলতে জনগণের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়। গণজমায়েত থেকে করোনা সংক্রমণের বিস্তার ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেন হ্লাইং। রয়টার্স ও আলজাজিরা।  

এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে কাজে যোগ না দেয়ায় ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছেন এসব কর্মচারী। একদিকে নিজ নিজ অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপ, অন্যদিকে সেনা সরকারের চাকরিচ্যুতির হুমকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের। আগেই অচল হয়ে পড়েছে দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থা। মঙ্গলবার হঠাৎ করেই থমকে যায় রেলসেবা। প্রায় ৯০ ভাগ রেলসেবা এদিন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। রেলওয়ের ডেপুটি জেনারেল ইউ টে হ্লা বলেন, ‘হঠাৎ করেই প্রায় ১০০ কর্মকর্তা আজ কর্মক্ষেত্রে আসেননি। মঙ্গলবার থেকেই বন্ধ হয়ে আছে ইয়াঙ্গুনের রেল পরিবহণ ব্যবস্থা। মাঝপথে ট্রেন থামিয়ে নেমে গেছেন সব চালক।’ তিনি আরও বলেন, লাইনে লাইনে পড়ে থাকা ট্রেনগুলো সংরক্ষণ ও সুরক্ষিত অবস্থায় নিজ নিজ জংশনে ফেরাতে রাজ্যে রাজ্যে চালক পাঠানো হচ্ছে কেন্দ্র থেকে। রেলওয়ের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপকও ধর্মঘটের পক্ষে। সরকারি নির্দেশ সত্ত্বেও কর্মীদের কাজে ফিরতে কোনো চাপও দিচ্ছেন না তিনি। 

সেন্ট্রাল ব্যাংক অব মিয়ানমারের (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) শত শত কর্মী এদিনও চাকরি ফেলে যোগ দেন অসহযোগ আন্দোলনে। কর্ম-ধর্মঘটে নামেন মিয়ানমার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (বিমান পরিষেবা নিয়ন্ত্র কেন্দ্র) কর্মীরাও। ফলে বিমান চলাচলও প্রায় বন্ধই। বিবিসি বার্মিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন দুই লাখ ডলার করে গচ্চা যাচ্ছে মিয়ানমার সরকারের। কাস্টম হাউজ, শিক্ষা-জ্বালানি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসনিক দফতর, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, খনি-জুয়েলারি-বন কর্মকর্তা সবখানেই একই গল্প। কাজ ছেড়ে বিক্ষোভে নেমেছেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। সেনা-সরকারের বিরোধিতাই অনড় দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোও। 

চলতি মাসের প্রথম দিন (সোমবার) রোহিঙ্গা গণহত্যায় অভিযুক্ত সেনাপ্রধান মিন অংয়ের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতার দখল নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। বন্দি করা হয় দেশটির নেত্রী অং সান সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ নভেম্বরের নির্বাচনে কয়েক ডজন এমপিকে। দেশজুড়ে জারি করা হয় এক বছরের জরুরি অবস্থা। এরপর নানা বিধিনিষেধ, বিরোধীদের ঢালাও গ্রেফতার-আটক, বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক দমন-পীড়নের মাধ্যমে দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মাধ্যমে সরকারের সব বিভাগই নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সেনা কর্তৃপক্ষের এ হুকুমত মানছেন না সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। 

অভ্যুত্থানের দুদিন পরই (বুধবার) অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন চিকৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা। এর পরপরই রাজপথে নামেন সু চি সমর্থকরা। এতে শামিল হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অব্যাহত রয়েছে বিভিন্ন আন্দোলন-কর্মসূচি। কয়েক হাজার সরকারি কর্মীও বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের নেতৃত্বে চলমান এ আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছে কৃষক-শ্রমিক-মজুর ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর অংশগ্রহণে তীব্র হয়ে উঠেছে আন্দোলন। এখন কাজ ছেড়ে আস্তে আস্তে রাস্তায় নামছেন সরকারের প্রায় প্রতিটি বিভাগের কর্মচারীই। যোগ দিয়েছেন পুলিশ ও নিরাপত্তা বিভাগের কর্মচারীরাও।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে