বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১, ০৯:৩১:৪৪

কেন 'শত্রু দেশ' ইসরায়েল যাবার সিদ্ধান্ত নেন মিশরের প্রেসিডেন্ট সাদাত

কেন 'শত্রু দেশ' ইসরায়েল যাবার সিদ্ধান্ত নেন মিশরের প্রেসিডেন্ট সাদাত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে ইসরায়েলে যান। সেটাই ছিল কোন আরব নেতার প্রথম ইসরায়েল সফর। মিশরের মিত্র দেশগুলোর বিরোধিতা, নিজের মন্ত্রিসভার ভেতরে মতৈক্য উপেক্ষা করে দীর্ঘ দিনের 'শত্রু দেশ' ইসরায়েলে যাবার তার ঐ সিদ্ধান্ত ছিল ঐতিহাসিক।

এর মাত্র চার বছর আগেই মিশর আর ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। বস্তুত কয়েক প্রজন্ম ধরেই এই দুই দেশের মানুষ পরস্পরকে শত্রু হিসাবে গণ্য করে এসেছে। সাদাত মনে করেছিলেন তার ইসরায়েল সফর শান্তির পথে হয়ত কিছুটা আশার আলো দেখাবে। প্রেসিডেন্ট সাদাত ১৯৭৭ সালের ৯ই নভেম্বর মিশরের সংসদে ঘোষণা করেন তিনি ইসরায়েলে গিয়ে তাদের সংসদে কথা বলার জন্য তৈরি আছেন যদি তার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি হয়। 

বেশিরভাগ মানুষই তার এই ঘোষণাকে বাগাড়ম্বর বলে নাকচ করে দিয়েছিল। এমনকি সংবাদমাধ্যমও এই খবর প্রচারে কোন আগ্রহ দেখায়নি। মিশরের তরুণ ক্যামেরাম্যান মোহাম্মদ গওহার সেদিন সংসদে সাদাতের ঐ ঐতিহাসিক ঘোষণা রেকর্ড করার দায়িত্বে ছিলেন।

মোহাম্মদ গওহার বিবিসির লুইস হিডালগোকে বলেছেন আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন এবিসি তাকে জানিয়েছিল তারা এ খবর প্রচারে আগ্রহী নয়, "কারণ এটা অবাস্তব- প্রেসিডেন্ট সাদাতের একটা কথার কথা মাত্র।" খবর হিসাবে এটাকে গুরুত্ব দিলে পরে তা ভুল প্রমাণিত হবে। গওহর বলেন, শুধু এবিসি চ্যানেলই নয়, মিশরেরও বেশিরভাগ মানুষ এবং অধিকাংশ বিশ্ব বিশ্বাসই করেনি যে আনোয়ার সাদাত আসলেই তার শত্রুর দেশে যেতে এবং সেখানে গিয়ে সংসদে কথা বলার ব্যাপারে আন্তরিক।

ইসরায়েলীদের মনেও সন্দেহ ছিল। কিন্তু তারা সাদাতের সাথে তাল দিতে রাজি ছিল। ওই ঘোষণার দুদিন পর তৎকালীন ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী মেনাকেম বেগিন মিশরীয় সংসদে একটি বার্তা পাঠান। তিনি বলেন. প্রেসিডেন্ট সাদাত যদি সত্যিই ইসরায়েলে যান তাকে স্বাগত জানানো হবে। কেন তিনি জেরুসালেমে আসতে পারবেন না? তিনি যদি আসেন, তাকে সবরকমে অভ্যর্থনা জানানো হবে। আমরা ক্নেসেটে তাকে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানাব।"

মোহাম্মদ গওহর তখন মিশরে কাজ করতেন ফ্রিল্যান্স ক্যামেরাম্যান হিসাবে। তিনি বলেন, "আমি সেসময় আনোয়ার সাদাতের পছন্দের একজন সাংবাদিক ছিলাম। তার ক্যামেরাম্যান এবং প্রযোজক হিসাবে আমি কাজ করতাম।" সংসদে ওই ভাষণের দিন কয়েক পর এবিসির প্রতিদ্বন্দ্বী একটি টিভি চ্যানেল সিবিএস গওহরকে একটা টেলেক্স পাঠায়।

তাদের ঝানু উপস্থাপক ওয়াল্টার ক্রনকাইট তাকে জানান তিনি এই খবরের ব্যাপারে আগ্রহী। তিনি প্রেসিডেন্ট সাদাত ও প্রধানমন্ত্রী বেগিনের লাইভ সাক্ষাৎকার নিতে চান। গওহরকে তিনি এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন এবং অনুরোধ করেন খবরটা সাদাতের কাছে পৌঁছে দিতে।

গওহর বলেন, 'আমি সোজা প্রেসিডেন্ট সাদাতের কাছে চলে যাই। তিনি তার বাগানে একটা গাছের ছায়ায় বসেছিলেন। আমি তার হাতে টেলেক্সটা দিই। তিনি পড়েন এবং বলেন ক্রনকাইটকে বলো আমি লাইভ সাক্ষাৎকার দিতে রাজি আছি।'' প্রেসিডেন্ট সাদাত তখনও বুঝতে পারেননি এই লাইভ ইন্টারভিউ ঠিক কেমন ভাবে হবে। গওহর তাকে বলেন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সময় সরাসরি তার সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। 

তিনি যখন কথা বলবেন সেটা নতুন উপগ্রহ প্রযুক্তির মাধ্যমে সরাসরি শ্রোতাদর্শকরা দেখতে পাবেন। কায়রোয় প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে বিশাল আকৃতির স্যাটেলাইট ডিশ বসানো হয়। গওহর বলেন, অনুষ্ঠান চলাকালীন ক্রনকাইটের ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না - কিন্তু কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। তিনি প্রেসিডেন্ট সাদাতকে জিজ্ঞেস করেছিলেন - আপনি কি সত্যিই জেরুসালেমে যাবার ব্যাপারে আন্তরিক? এটা কি সত্যিই আপনার মনের ইচ্ছা?" 

গওহরের মনে আছে: "সাদাত উত্তর দিয়েছিলেন, অবশ্যই যদি আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।" ক্রনকাইট প্রধানমন্ত্রী বেগিনকে পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি প্রেসিডেন্ট সাদাতকে আমন্ত্রণ জানাবেন কি না। "বেগিন বলেন, সাদাতকে আমন্ত্রণপত্রটি তাদের হয়ে পাঠাবেন কায়রোয় অ্যামেরিকান রাষ্ট্রদূত এবং তাকে ফারাওয়ের সম্মান দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হবে।"

আরব ঐক্যের মৃত্যু : আনোয়ার সাদাতই প্রথম আরব নেতা, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের জন্মের পর যিনি ইসরায়েলের মাটিতে প্রথম পা রাখতে যাচ্ছেন। ফলে তার এই পদক্ষেপ বিশাল বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। ইসরায়েল ও মিশর তখনও এক অর্থে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে। আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সাথে প্রকাশ্যে কোনরকম যোগাযোগ রাখবে না বলে যে মতৈক্যে পৌঁছেছিল, সাদাতের এই সিদ্ধান্তকে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে দেখল আরব দেশগুলো।

প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল আরব দুনিয়া। শুরু হল বিক্ষোভ, চলল বোমা হামলা। সিরিয়া একদিনের শোক ঘোষণা করল। বলল, "আরব ঐক্যের মৃত্যু ঘটেছে"। সাদাতের ইসরায়েল সফরের সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন চারিদিকে বিক্ষোভের ডামাডোল তখন বাধা আসল নানা দিক থেকে। গওহর বলেন, "তার মেয়ে অন্ত:স্বত্তা, আসন্ন-প্রসবা, স্ত্রী সঙ্গে যাবেন কিনা মনস্থির করতে পারছেন না। ওদিকে তার পররাষ্ট্র মন্ত্রীও পদত্যাগ করেছেন।''

গওহর বলেন, সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই সফরে যাবার পেছনে তাকে প্রেরণা জুগিয়েছিল একটি ঘটনা। তাকে মনস্থির করতে সাহায্য করেছিল একটি চিঠি। ইসরায়েলের সাথে ১৯৭৩ সালে মিশরের যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট সাদাতের স্ত্রী জেহানকে চিঠি লিখেছিলেন একজন ইসরায়েলী মা, যার ছেলে যুদ্ধের সময় নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। ওই চিঠিটিই ছিল একজন ইসরায়েলী এবং একজন মিশরীয় নাগরিকের মধ্যে প্রথম মানবিক পর্যায়ে যোগাযোগ।"

গওহর বলছেন ইসরায়েলের মানুষের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগের কথা তারা ভাবতেও পারতেন না। "স্কুলে আমাদের সবসময় শেখানো হয়েছে ইসরায়েলী বলে আসলে কোন জাতি নেই। তাদের কোন অস্তিত্ব নেই। "ইসরায়েলীদের আমরা শুধু ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনেই দেখেছি। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামেয়ারের নাম শুনলে আমাদের চোখে ভেসে উঠত লম্বা নাকের এক মহিলার ছবি আর মোশে দয়ান আমাদের কাছে ছিলেন ব্যান্ডেজে চোখ বাঁধা এক সামরিক নেতা!"

গওহর বলেন, মিসেস সাদাত তার স্বামীকে ওই চিঠির কথা না জানিয়ে ইসরায়েলী মাকে সরাসরি চিঠির জবাব দেন। মিসেস সাদাত লেখেন: "একজন মিশরীয় মায়ের তরফ থেকে একজন ইসরায়েলী মাকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- আপনার ছেলেকে আমি খুঁজব।" গওহর বলেন পরে সাদাত এই চিঠির কথা জানতে পেরে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন। কারণ শত্রুর সাথে তার স্ত্রী চিঠি চালাচালি করেছেন এটা তিনি প্রথমে মেনে নিতে পারেননি।

মোহম্মদ গওহর বলেন, "কিন্তু ইসরায়েলী সংবাদমাধ্যমে ওই চিঠি ইতিবাচক সাড়া ফেলে দেবার পর তিনি মত বদলান। তিনি তার স্ত্রীকে বলেন, ইসরায়েলীদের দিক থেকে মিশর নিয়ে এমন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আমি আগে কখনও দেখিনি। স্ত্রীকে তিনি বলেন, তুমি এক লাইনের চিঠিতে যেভাবে ইসরায়েলীদের মন জয় করেছো, আমিও সেভাবে ইসরায়েলী মানুষের কাছে পৌঁছতে চাই। আমার ধারণা তাকে জেরুসালেম যাবার প্রেরণা জুগিয়েছিল ওই চিঠি।"

ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগের শক্তি তিনি অনুধাবন করেন এই চিঠি লেখার ঘটনাটির মধ্যে দিয়ে। ওয়াল্টার ক্রনকাইটকে সাক্ষাৎকার দেবার পাঁচ দিন পর, ১৯৭৭ সালের ১৯শে নভেম্বর আনোয়ার সাদাতের বিমান অবতরণ করে ইসরায়েলের বেন গুরিয়ান বিমানবন্দরে। মিশরের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে যানবহরের জেরুসালেম যাত্রা দেখার জন্য পথে লাইন দিয়েছিলেন হাজার হাজার ইসরায়েলী। সেদিন পরের দিকে সাদাত, গওহরের সফরসঙ্গী মিশরের এক সাংবাদিক আনিস মনসুরকে তার হোটেল রুমে ডেকে পাঠান।

"সাদাত আনিসকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা বিমানবন্দর থেকে হোটেল যাওয়া পর্যন্ত তুমি কী দেখলে? আনিস বলেছিল, প্রেসিডেন্ট হাজার হাজার ইসরায়েলী আপনাকে দেখার জন্য রাস্তায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল আপনি সত্যিই তাদের সাথে আছেন কিনা। সাদাত বলেছিলেন, আনিস আমিও যাত্রাপথে তাদের চোখে চোখ রেখে তাদের মন বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি তোমাকে আশ্বাস দিতে পারি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসছে।"

আনোয়ার সাদাত পরের দিন ইসরায়েলী সংসদ ক্নেসেটে গিয়েছিলেন একই বার্তা নিয়ে। তিনি বলেছিলেন: "আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের সবার জন্য শান্তি আসুক। আরব দুনিয়ায় এবং ইসরায়েলে শান্তি আসুক।" কায়রোর মানুষ টিভিতে দেখেছিলেন তাদের প্রেসিডেন্টের ইতিহাস সৃষ্টির সেই মুহূর্ত।

গওহর বলেন, "মিশরের পথেঘাটে সেদিন একটাও মানুষ ছিল না। রাস্তা ছিল ফাঁকা। ইসরায়েলী সংসদ ক্নেসেটে মিশরের প্রেসিডেন্টের ভাষণ শুনতে সবাই ছিল টেলিভিশনের সামনে।" পরে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী মেনাকেম বেগিন, সাদাত যে বিশাল ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাকে অভিনন্দন জানান।

"এটা আসলেই ঐতিহাসিক একটা সফর। আমাদের দুই দেশের মধ্যে সরকারি অর্থে যুদ্ধ চলছে। একটা দেশ যখন তার শত্রু দেশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, তখন সেই দেশের নেতা তার শত্রু দেশ সফরে গেছে, আর সেই শত্রু দেশ তাকে সাদরে ও উষ্ণভাবে অভ্যর্থনা করেছে, এমন নজির ইতিহাসে নেই," বলেন মেনাকেম বেগিন। ওই সফরের ১৮ মাস পর ইসরায়েল ও মিশর একটি শান্তি চুক্তিতে সই করেছিল।

গওহর বলছেন স্বদেশে ফেরার পর আনোয়ার সাদাতকে অভিনন্দন জানাতে লাখো লাখো মানুষ ভেঙে পড়েছিল কায়রোর রাস্তায়। "আমি তার যানবহরের সামনে একটা ট্রাকে ছিলাম। তিনি বিমানবন্দরে নামার মুহূর্ত থেকে তার গাড়ির বহর গিযায় তার প্রাসাদে পৌঁছন পর্যন্ত গোটা যাত্রাপথের ফিল্ম আমি তুলেছিলাম। রাস্তায় মানুষের ঢলে মাত্র ১৪ মাইল পথ যেতে তার গাড়িবহরের সময় লেগেছিল আড়াই ঘন্টা।"

সাদাত আর বেগিন যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে গওহরের মতে এর মূল্য প্রেসিডেন্ট সাদাতকে দিতে হয়েছিল তার জীবন দিয়ে। ওই সফরের চার বছর পর আততায়ীর গুলিতে নিহত হন মিশরের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত। তার হত্যাকান্ডে পেছনে ইসরাইল-মিশর শান্তিচুক্তি ভূমিকা পালন করেছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে