শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৬, ০২:৩৩:২৪

রাজনীতিতে ক্রোধের চেয়েও মারাত্মক উপহাস

রাজনীতিতে ক্রোধের চেয়েও মারাত্মক উপহাস

এম জে আকবর : রাজনীতিতে প্রতিশোধ গ্রহণের মতো কঠোর সাজা আর হয় না। রাজনীতিকমাত্রই এটা ভালো করে জানেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ও তার মুরব্বি ‘সুপার মুখ্যমন্ত্রী’ লালুপ্রসাদ যাদব, দুজনই গণতন্ত্রের মৌলিক একটা বিষয় ভুলে গেছেন।

বিষয়টি হচ্ছে— ‘গরিবের তালিকার খাদ্য সরকারের ভোগে কখনোই লাগাতে নেই।’ ভোটের লড়াইতে দক্ষ-অভিজ্ঞ যোদ্ধা ও প্রশাসনিক কাজে পটু নীতিশ ও লালু কথাটা উপেক্ষা করলেন কীভাবে! বিলাসে মগ্ন হওয়ার জন্য গরিবের হাতে সুযোগ নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় বৈকালিক অবসরে অল্প দামে কিছু একটা যেমন সমোচা ও ভুজিয়া খেতে পারলে সেটাই তার কাছে হয়ে ওঠে আনন্দঘন মুহূর্ত। বাজেটীয় পরিভাষায় একটা শব্দ আছে ‘পাপ কর’ (ইংরেজিতে ‘সিনট্যাক্স’)। এ খাত থেকে প্রাপ্তি যে কোনো সরকারের কাছে নিয়মিত সম্পদ খাঁটি হিসেবে বিবেচিত। মদ ও সিগারেটের মতো পণ্যের ওপর ধার্য করকে পাপ কর বলা যায়।

বিশুদ্ধবাদিতার মনোভঙ্গি কঠোরতর হয়ে উঠলে পাপ করের আওতা প্রসারিত করে বিভিন্ন বিলাসকেও ছোঁয়া যায়, যেমন ধরুন ব্যয়বহুল হোটেল। কিন্তু কোনো অর্থমন্ত্রীই চাপ দিয়ে ওখান থেকে অর্থ আহরণের বুদ্ধি প্রয়োগ করেন না। বিহারের ভোটাররা কিছু দিন আগে একটা সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তারা এখনই এই সরকারের ওপর ক্রুদ্ধ হলে তা হবে অতিজলদি ব্যাপার। কিন্তু সমোচা ও ভুজিয়ার ওপর ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করায় ক্রোধের চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার ঘটে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হওয়ার উপক্রম।

রাজনৈতিক ক্রোধের চেয়েও মারাত্মক হচ্ছে উপহাস। উপহাস করা, টিটকারি দেওয়া, দুয়ো ধ্বনি তোলা এসব ক্ষেত্রে বিহারিদের মতো নৈপুণ্য কারও নেই। সমোচা তাদের কাছে সত্যিকারের স্বাদু খাদ্যসামগ্রী। করজনিত মূল্যস্ফীতি এ খাদ্যটিকে ‘দূরের জিনিস’ করে তুললে তারা যে উপহাসে মত্ত হবে তা শ্রেণি-বর্ণ সম্প্রদায়কে সংবদ্ধ করবে। সমোচা আজকাল ফাস্টফুডের জাতে উঠেছে। বিষয়টা নতুন মনে হলেও মোটেই নতুন নয়।

বহুজাতিক কোম্পানিরা ফাস্টফুডের আবেদন আবিষ্কার করার বহু আগে ভারতীয়রা এ খাদ্যটি উদ্ভাবন করে। আমরা ভারতীয়রা আমাদের শুভ বুদ্ধির প্রয়োগ দ্বারা ফাস্টফুডকে গার্হস্থ্য শিল্প করে রেখেছি। এটা এমন একটি ব্যবসা যার দ্বারা গরিব মানুষ জীবিকানির্বাহ করতে পারে। এ ধরনের খাবার যারা বানায় আর যারা খায়, দেখা গেছে তারা একই ধরনের আর্থ-সামাজিক বলয়ে বাস করে। সমোচা নামক যে বড়শি বিহার সরকারকে গেঁথেছে, তার যন্ত্রণা নীতিশ ও লালু দুজনকে ভাগ করে নিতে হবে।

ভ্যাট বসানোর মূল সিদ্ধান্ত যে মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ের তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিহারের অর্থমন্ত্রী তো লালুর দলের, নীতিশের নয়। তাই মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার প্রকাশ্যে যত সমালোচনা এড়িয়ে যেতে পারেন, লালুপ্রসাদ ঘরোয়া আলাপকালে তা পারছেন না। ঢালাওভাবে সব সমোচার ওপর নয়, সুদৃশ্য প্যাকেটবদ্ধ উচ্চমূল্যের সমোচার ওপরই শুধু ভ্যাট বসাতে চেয়েছেন, এরকম কথাবার্তা বলে তাপ কমানোর চেষ্টা করছেন নীতিশ।

তার এ ব্যাখ্যাটা ‘করিয়া ভাবিতেছি, ভাবিয়া করি নাই’র মতোই। ভুজিয়ার ওপরও ভ্যাট আছে। ভুজিয়া সম্বন্ধে কিছুটা না বলায় নীতিশের যুক্তিটা ল্যাংড়া হয়ে গেছে। মশা প্রতিরোধক সামগ্রীর ওপরও ভ্যাট বসানো হয়েছে। বিহারে আছে এই সামগ্রীর বিরাট বাজার। সরকার আশা করে এ খাতে বিরাট অংকের রাজস্ব আসবে। ধারণা করা হয়, শুধু পাটনা নগরী থেকে যে ভ্যাট উঠবে তাতে সরকারি একটা অধিদফতরের পুরো খরচ মেটানো যাবে।

বিহার রাজ্যটি মশত আকীর্ন জনপদ। এ রাজ্যে কর বসানোর মতো শিল্প কারখানা আর নেই। তাই, মশা তুমি ভরসা। কেউ যদি বলে, সরকার তার অতীতের ব্যর্থতা থেকে লাভবান হতে চাইছে, তাহলে কথাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে মশা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেভাবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন খানাপিনায় খুবই অভিজাত। তিনি একবার জনতার একজন হয়ে দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে সমোচাসদৃশ ব্রিটিশ খাবার ‘কর্নিশ পাই’ খেতে গেছেন। সাধারণ মানুষের খাদ্য কর্নিশ পাই কীভাবে খেতে হয় তার জানা ছিল না। তাই খাওয়ার সময় তালগোল পাকিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড করে বসলেন। ফলত জনমুগ্ধতা অর্জনের চেষ্টাটি মাঠে মারা গেল।

সুযোগটি দ্রুত হস্তগত করল পত্রিকাওয়ালারা। তারা ক্যামেরনকে তুলাধোনা করা ছাড়া সবই করেছে। তবুও তিনি রুষ্ট হয়ে কর্নিশ পাইর ওপর ভ্যাট বসাননি। সমোচা-ভুজিয়া ট্রাজি-কমেডি এমন এক সময়ে ঘটছে লালু-নীতিশ সরকারের ওজন যখন কিছুটা কমতে শুরু করেছে। কমতির পেছনে মজাদার কিছু কাজ করছে না। কাজ করছে অপরাধ।

দুর্বৃত্তরা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পাওয়ায় বিহারে আবার দাপুটে হয়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলে শঙ্কাবোধ তীব্র হচ্ছে। সেখানকার সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হুকুম ফলাচ্ছে সমান্তরাল লালুযাদব নেটওয়ার্ক। কর্মকর্তারা তো জানেন সত্যিকারের ক্ষমতা কার হাতে। এ অবস্থায় সমোচা ঘটনা নীতিশ কুমারের সুনামহানি করে চলছে। বিডি প্রতিদিন

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক।

২২ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে