আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বাঙালি হওয়ায় অবহেলার শিকার! চিরকাল অবহেলিত হয়ে চলেছেন বাঙালিরা! এমনকী, ভারত সরকারের কাছেও বাঙালিদের হতে হয় অবহেলিত! যে কারণে, দুই ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বাংলাকে!! এবং, যে কারণে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া হয়নি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে!!
শুধুমাত্র তাই-ই নয়৷ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে হত্যা করা হয়েছিল!! কেননা, এই ধরনের মতামত রয়েছে, সাইবেরিয়ার ইয়াকুতস্ক জেলের ৪৯ নম্বর সেলে অত্যাচার করে, প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে মুখ বন্ধ করে, নেতাজিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল!! এবং, এই ধরনের মতামত সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে!!
তিন দিন আগে, ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে একশ’টি ফাইল প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ আগামী দিনে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতাজির বিষয়ে আরও ফাইল প্রকাশ করা হবে বলেও জানানো হয়েছে৷ গত বছর ৬৪টি ফাইল প্রকাশ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-ও৷ অথচ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিষয়ে এখনও বহু তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহলের বিভিন্ন অংশ৷ তার উপর, গত ২৩ জানুয়ারি যে একশ’টি ফাইল প্রকাশের কথা জানানো হয়েছে, সে বিষয়েও বিভিন্ন মহলে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা৷
কারণ, কোন এক শ’টি ফাইল প্রকাশ হল! আগে প্রকাশ হয়েছে যে সব ফাইল, সেই সব-ও রয়েছে এই একশ’র মধ্যে!! তেমনই, শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে-ও আবার নয়৷ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে নতুন করে দেখা দিয়েছে নেতাজির বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন৷ আর, এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যেই, মঙ্গলবার ২৬ জানুয়ারি, সাধারণতন্ত্র দিবসে ফের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে!
ওই বিতর্কের সূচনা হয়েছে ‘লজ্জা-র শিল্পী’ তসলিমা নাসরিনের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে৷ এবং, এ দিনের ওই বিতর্ক আরও জোরদার হয়ে উঠেছে তসলিমা নাসরিনের ওই মন্তব্য এবং তার পাল্টা বিভিন্ন ধরনের মন্তব্যকে কেন্দ্র করেও৷ তেমনই, শুধুমাত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু-ও নন৷ নেতাজির সঙ্গে বিতর্ক জুড়ে দেওয়া হয়েছে বাঙালি, দেশভাগের যন্ত্রণা এবং ভারতীয় নাগরিকদের সমানাধিকারের প্রসঙ্গেও৷ ফেসবুকে মঙ্গলবার তসলিমা নাসরিন এমন মন্তব্য করেছেন, ‘১১২ জনকে পদ্ম সম্মান দিয়েছে ভারত৷ বাঙালি ক’জন ১১২ জনের মধ্যে? মাত্র এক জন৷ ভারত সরকার চিরকালই বাঙালিদের হেলা করেছে৷ সুভাষ বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি৷ বাংলাকে দু’ভাগ করে দুর্বল করেছে৷ এখন আবার কৃতী ব্যক্তিত্বদের পদ্ম পাওয়া থেকে বঞ্চিত করছে৷ আমি বাংলা ফ্যানাটিক নই৷ কিন্তু বৈষম্যটা বড় চোখে লাগে৷’
ফেসবুকের ওই মন্তব্যে ‘লজ্জা-র শিল্পী’-র দাবি অনুযায়ী, বাঙালি সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি অন্ধভক্ত নন৷ তবে, লেখিকার ওই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে কোনও কোনও মহল থেকে যেমন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তসলিমা নাসরিনের এই ধরনের মন্তব্যের জেরে বাঙালিদের-ই কি অসম্মান করা হল না? কোনও কোনও মহলের প্রশ্ন, লেখিকার এই ধরনের মন্তব্যে ভারতীয় গণতন্ত্রকে-ই কি আঘাত করা হল না? তেমনই আবার, কোনও কোনও মহল থেকে এমন প্রশ্ন-ও তোলা হচ্ছে, বাঙালিরা অবহেলার শিকার, এই ধরনের মন্তব্যের জেরে গণতান্ত্রিক এ দেশে কি বিদ্বেষের আবহ তৈরি করলেন না লেখিকা? যে কারণে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন ঘটনায় তৈরি অসহিষ্ণুতার আবহে, তসলিমা নাসরিনের এই ধরনের মন্তব্য বিতর্ক ফের উসকে দিল বলেও মনে করছে কোনও কোনও মহল৷
তবে, তসলিমা নাসরিনের খাস অনুরাগীদের অনেকেই অবশ্য লেখিকার এই ধরনের মন্তব্যকে সমর্থন করছেন৷ লেখিকার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন৷ শুধুমাত্র যে সমর্থন-সহমত পোষণ করছেন, তাও নয়৷ তাঁর খাস অনুরাগীদের অনেকে আবার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন৷ ওই আশঙ্কা, এই ধরনের মন্তব্যের জেরে তসলিমা নাসরিন আর কত দিন ভারতে থাকার অনুমতি পাবেন, সেই বিষয়ে৷ তবে, ‘লজ্জা-র শিল্পী’র ওই ধরনের মন্তব্যের জেরে, ফেসবুকেই তাঁর খাস অথবা সাধারণ অনুরাগীরা যেভাবে পাল্টা মন্তব্য করেছেন, সে সবের জেরেও ক্রমে আরও জোরদার হয়ে উঠছে বিতর্ক৷ এবং, ওই সব মন্তব্য আর সে সবের পাল্টা মন্তব্যের জেরেও এমনও প্রকাশ পাচ্ছে যে, ভারত, গণতান্ত্রিক এক দেশ৷
মঙ্গলবার, সাধারণতন্ত্র দিবসে, তসলিমা নাসরিনের ফেসবুক-মন্তব্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নাম-ও৷ ফেসবুকে লেখিকার-ই এক অনুরাগীর এমন মন্তব্য, ‘জওহরলাল নেহরু ছিলেন বাংলা এবং বাঙালি বিদ্বেষী৷’ তার কারণ হিসেবে ওই অনুরাগীর যুক্তি, ‘এ দেশে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য সেভাবে কিছুই করেননি৷ অথচ, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এ দেশে আগত শরণার্থীদের জন্য উদ্বাস্ত কলোনি স্থাপন, সম্পত্তি বিনিময়, অনেক কিছুই করেছিলেন৷ এমনকী, অর্থের বরাদ্দ-ও অনেক বেশি ছিল পশ্চিমের ওই শরণার্থীদের জন্য৷’ তবে, ‘অপ্রিয় সত্যি’ কথার জন্য লেখিকার অনেক অনুরাগী-ই আবার বেশ খুশি হয়েছেন বলেও প্রকাশ পেয়েছে তাঁদের বিভিন্ন ধরনের মন্তব্যে৷
ফেসবুকে তসলিমা নাসরিনের ওই মন্তব্যের জেরে, তাঁর-ই এক খাস অনুরাগীর এমন মন্তব্য: ‘সুভাষচন্দ্র বসু অবিভক্ত ভারত থেকে হারিয়ে গেলেন, সেই দিক দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু যতটা আমার ততটাই আপনার ও সব বাঙালির৷ তিনটে মত আছে তাঁর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে৷ এক, বিমান দুর্ঘটনা, এটা বাতিল৷ দুই, সাইবেরিয়ার ইয়াকুতস্ক জেলে সেল নম্বর ৪৯-এ টর্চার করে মুখে প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে বন্ধ করে শ্বাসরোধ করে হত্যা৷ তিন, ফইজাবাদের গুমনামী বাবা৷ ভারত সরকার সব জানে কী হয়েছিল৷ আজ প্রায় ৭০ বছর ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে কী হয়েছিল৷ এমন কিছু খারাপ হয়েছিল যা খুব লজ্জার৷ ঠিক কী চুক্তি হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে, সেই সময়ের ভারতীয় নেতৃত্ব আর ব্রিটিশ, রাশিয়া মিত্র শক্তির মধ্যে কেউ জানে না৷ অনেকে লড়ছে এই দেশে ওই সত্যি যাতে সবার সামনে আসে৷ আপনার মতো মানুষ যখন কিছু বলেন এই বিষয়ে, তখন সেটা আরও গুরুত্ব পায়৷’ আর, ফেসবুকে এই ধরনের মন্তব্যের জেরে তসলিমা নাসরিনের পাল্টা মন্তব্য: ‘দুই নম্বর মতটা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷’
কেন্দ্রীয় সরকারের পদ্ম সম্মানকে কেন্দ্র করে-ই এ দিন ফেসবুকে যে মন্তব্য করেছেন তসলিমা নাসরিন, সেই মন্তব্যকে সমর্থন করেননি, তাঁর এমন অনুরাগীও রয়েছেন৷ তেমনই এক অনুরাগীর মন্তব্য, ‘তসলিমা নাসরিনের ওই মন্তব্য যথাযথ নয়৷ কোনও বাঙালির যোগ্যতা থাকলে, তিনিও পাবেন কোনও পদ্ম সম্মান৷ একই সঙ্গে সকলকে এই সম্মান দেওয়া সম্ভব নয়৷’ তার উপর, শুধুমাত্র এই বছরের তালিকা দেখে লেখিকার ওই ধরনের মন্তব্য করা ঠিক নয় বলেও পাল্টা মন্তব্য করা হয়েছে ফেসবুকে৷ তেমনই, কোনও অনুরাগী আবার এমন প্রস্তাবও দিয়েছেন যে, ‘এ দেশের প্রতিটি রাজ্যের কোটা অনুযায়ী পদ্ম সম্মান প্রদান করা উচিত৷ তা হলে, এই ধরনের প্রশ্ন আর উঠবে না৷’ যদিও, পদ্ম সম্মান প্রদানকে কেন্দ্র করেও বিভিন্ন সময় কম দেখা দেয়নি বিতর্ক৷ এই বছরও তার ব্যতিক্রম নয়৷
৮৭ বছরের গিরিজা দেবী এ বার ভূষিত হয়েছেন বঙ্গবিভূষণ সম্মানে৷ তিনি বেনারস ঘরানার কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিত৷ তাঁকে ঠুংরির রানি বলা হয়৷ এবং, পদ্ম প্রাপকদের তালিকায় এ বার গিরিজা দেবী-ই একমাত্র, যাঁর নামের পাশে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ৷ পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ এবং পদ্মশ্রী মিলিয়ে এ বার যে ১১২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ পেয়েছে, সেখানে বাঙালি রয়েছেন চার জন৷ তবে, তাঁদের নামের পাশে নেই পশ্চিমবঙ্গ৷ ওই চারজন হলেন: সোমা ঘোষ, সব্যসাচী সরকার, টিকে লাহিড়ি এবং দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়৷ তাঁদের মধ্যে দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের নামের পাশে রয়েছে কর্ণাটক এবং অন্য ওই তিন বাঙালির নামের পাশে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ৷ -কলকাতা
৩১ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন