আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সবেমাত্র তিন মাস হয়েছে বাবা মারা গেছেন। নয় বছরের মেয়েটা এখনো ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে। মাঝরাতে ডাকাত দল যখন ঘরে ঢুকে লুটপাট চালাচ্ছিল ঋতরাজ্ঞী বলে ফেলেছিল, বাবা থাকলে এমন করতে পারতে না!
আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে এমন খবর জানা গেছে।
এতবড় অপরাধটা ক্ষমা করেনি ডাকাতরা। ওইটুকু মেয়েকে বেদম গালাগালি করে গলায় ভোজালি ঠেকিয়ে, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হাত মুচড়ে খুলে নিয়ে যায় ইমিটেশনের আংটি। এ ঘটনা ঘটে শুক্রবার রাতে ভারতের বেলঘরিয়ার আদর্শনগরে।
বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে এমনিতেই মন খারাপ করে বসে থাকে মেয়েটা। ঠিক করে খেতে চায় না। স্বপ্ন দেখে ডুকরে ওঠে। কষ্টে কুঁকড়ে থাকা সেই মনটাকেই আবার খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে দিয়ে গেল ডাকাতরা। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ওই বিভীষিকার পর আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাকে। ঋতরাজ্ঞীকে ডাক্তাররা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
ঋতরাজ্ঞীর মা আর ঠাকুমা শনিবার সন্ধ্যায়ও স্বাভাবিক হতে পারেননি। তিন মাস আগে হারিয়েছেন রাজীবকে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসকের দফতরে কাজ করতেন। বছরখানেক আগে মারাত্মক ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।
বিকল হয়ে যায় দু’টি কিডনিই। বছর কয়েক আগে এ অসুখই হয়েছিল রাজীবের বাবারও। তিনি বাঁচেননি। বাঁচলেন না ছেলেও। সেই শোক, টাকার টানাটানি, সঙ্গে ভবিষ্যতের চিন্তা।
তার মধ্যে বাড়িতে এই আকস্মিক ডাকাতি টাকা-পয়সা-গয়নাগাটি যেটুকু ছিল তো নিয়েই গেল, পাশাপাশি ভেঙে দিয়ে গেল কোনোমতে ঘুরে দাঁড়ানোর মনের জোরটুকুও।
বাচ্চা মেয়েটাকে কী করে একটু স্বাভাবিক রাখা যায়, সেই ভাবনায় ছিল সবাই। এখন কচি মনের উপরে নতুন করে আঘাতকে কী করে সারিয়ে তুলবেন সেই দুশ্চিন্তায় তারা।
আদর্শ নগরের একদিকে রামকৃষ্ণ মিশনের ফাঁকা জমি, অন্যদিকে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। কর্পোরেশন স্কুলের সাবেক শিক্ষিকা ঋতরাজ্ঞীর ঠাকুমা উমা বর্মনের একতলা বাড়িতে বাসিন্দা তিনজন।
উমা (৭০), পুত্রবধূ গীতা (৩৮) এবং শিশুকন্যা ঋতরাজ্ঞী। ওরা ভয় পান বলে গীতার দিদি রেখা মিত্র রাতটুকু এখানে কাটান। পরিবারে রোজগার বলতে উমার হাজার সাতেক টাকা পেনশন। দু’দিন আগে দু’মাসের পেনশন তুলে ঘরে রেখেছিলেন।
গীতাদেবীর অভিযোগ, শুক্রবার রাত ২টার দিকে সাত ডাকাতের একটি দল বাড়িতে চড়াও হয়। সামনে কোলাপসিবল গেটের দু’টি তালা চাড় দিয়ে ভাঙে। এরপর ঘরে ঢোকার মূল দরজাটির ছিটকিনিও ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলে।
দু’কামরার বাড়ির প্রথম ঘরটিতে ঘুমিয়েছিলেন উমাদেবী আর ভেতরের ঘরে বাকি তিনজন। অভিযোগ, প্রথমে উমাদেবীর গলা টিপে ধরে আলমারির চাবি দিতে বলে এক ডাকাত। মাথায় পাইপগানের নল চেপে ধরে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
বাকিরা মাঝের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। শাশুড়ির কিছু হয়েছে ভেবে দরজা খুলে দেন গীতা। হুড়মুড়িয়ে জনা পাঁচেক ডাকাত ঢুকে পড়ে ভেতরে। ঋতরাজ্ঞীর গলায় ভোজালি ধরে হুকুম করে, গয়না-টাকা-মোবাইল বের করে দিন!
রেখাদেবী বাধা দিয়ে বলেন, ওইটুকু মেয়ের গলায় ভোজালি ধরেছেন কেন? কেটে যাবে তো! ডাকাতরা সপাটে থাপ্পর কষিয়ে দেয় তাকে। আলমারি হাতিয়ে যা নেয়ার নিয়ে তিন মহিলার হাতে, গলায় যেটুকু গয়না ছিল সেটুকুও খুলে নেয় তারা।
গীতাদেবী অনুরোধ করেছিলেন, মেয়েটাকে কিছু করবেন না। কিন্তু ততক্ষণে একজনের নজর চলে যায় ঋতরাজ্ঞীর মধ্যমায় নতুন আংটিটার দিকে। শুক্রবারই এক আত্মীয়া কিনে দিয়েছিলেন ঝুটো আংটি।
সোনা ভেবে সেটিকে খুলে নেয়ার চেষ্টা করলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ঋতরাজ্ঞী। অমনি সজোরে একখানা চড় এসে পড়ে তার নরম গালে। দুঃখী মেয়েটা তখনই বলে ফেলেছিল বাবার কথা। যেই না বলা, শুরু হয়ে গেল অকথ্য গালাগালি।
কান্নার আওয়াজ চাপতে মুখে বালিশ ঠেসে ধরল ডাকাতরা। ওইটুকু মেয়ের হাত মুচড়ে সত্যিই খুলে নিয়ে গেল আংটি। শনিবারও ঋতরাজ্ঞীর নীল হয়ে থাকা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ।
গীতাদেবীর কথায়, শ্বশুর আর স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। তবু মেয়েটাকে আগলে রাখতাম। কেউ কোনোদিন ওর গায়ে হাত তোলেনি। কত সাধ করে দু’জনে নাম রেখেছিলেন ‘ঋ়তরাজ্ঞী’।
বাবার বড় আদরের মেয়ে যে! বাবাই স্কুলে নিয়ে যেতেন! প্রতি রোববার বাবার হাত ধরে বাজারেও যেত মেয়ে। সেই মেয়েকে কি না মার খেতে হলো ডাকাতের হাতে! মানতে পারছেন না বাড়ির কেউই।
গীতা-উমা-রেখা ডাকাতদের মুখ দেখতে পাননি। ওদের মুখ ঢাকা ছিল। কিন্তু বাংলায় কথা বলছিল, জানালেন তারা। ডাকাতরা চলে যাওয়ার পর এক দাদাকে খবর দেন গীতা।
তিনিই পুলিশকে জানান। প্রথমে নিমতা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পরে বেলঘরিয়া থানার পুলিশও পৌঁছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, বাড়িতে শুধু মহিলারা আছেন জেনেই হানা দিয়েছিল ডাকাতরা। রাজীবের কর্মস্থল থেকে মোটা টাকা পাওয়া গেছে বলে ভেবেছিল তারা।
ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান অজয় ঠাকুর বলেন, তল্লাশি শুরু হয়েছে। সব থানাকে সচেতন করা হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, আদর্শনগর চিরকালই অপরাধের স্বর্গরাজ্য। বারবার বলেও এলাকায় টহলদারি বাড়ানো যায়নি।
৭ ফেব্রুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম