এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক: ‘বাংলাদেশ সরকার যদি সত্যিই চায় শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য তাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক, তাহলে তাদের আগে এটা প্রমাণ করতে হবে যে তার বিচারের পদ্ধতিটা প্রতিহিংসামূলক নয়, বরং পুনরুদ্ধারমূলক (‘রেস্টোরেটিভ’) হবে। এটা নিশ্চিত করা গেলে তবেই শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য ভারতের ওপর সঠিক চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব।’
ভারতে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা এই মুহূর্তে সে রকমটাই মনে করছেন এবং তাদের এই ধারণার একটা পরিপ্রেক্ষিতও আছে। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এই ভাবনার কথা ও এর পেছনের যুক্তিগুলো শেয়ার করেছেন তারা।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) কৌঁসুলি ও প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী করিম আসাদ আহমদ খান সদ্য বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। গত ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া চারদিনের ওই সফরে তিনি মূলত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়নে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে কিনা, তার তদন্তেই ব্যস্ত ছিলেন।
তবে এই সফরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও বুধবার (২৭ নভেম্বর) তার বৈঠক হয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত ১৭ নভেম্বর ড. ইউনূস যখন টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন, সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টের অস্থিরতার সময় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ যারা ঘটিয়েছে—সেই অভিযুক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার জন্য তিনি করিম এ এ খানের সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছেন।
ফলে এটা প্রত্যাশিত ছিলই যে ঢাকাতেও বিষয়টি নিয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা হবে এবং হয়েছেও তাই। সেদিনের বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে এক পোস্টে জানানো হয়েছে, জুলাই-আগস্ট গণহত্যা এবং শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনে অসংখ্য গুমের ঘটনায় আইসিসিতে যাতে মানবতাবিরোধী অপরাধে তার বিচার করা যায়, বাংলাদেশ সরকার সেটা নিশ্চিত করতে চাইবে।
আরও জানানো হয়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে আইসিসি সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত বলেও প্রসিকিউটর করিম এ এ খান আশ্বাস দিয়েছেন।
তাহলে প্রশ্ন হলো, প্রধান উপদেষ্টা কেন আইসিসিতে এই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একটি পৃথক বা সমান্তরাল তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন? বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কি উপলব্ধি করছে যে আইসিটিবিডিতে এই বিচারের কোনও সীমাবদ্ধতা আছে এবং সেই ট্রাইব্যুনালে বিচার হলে তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে?
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে যে দেশের আতিথেয়তায় আছেন এবং বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়টি যাদের ওপর নির্ভর করছে– সেই ভারত কিন্তু মনে করছে, আইসিটিবিডিতে বিচার হলে শেখ হাসিনা বা অন্য অভিযুক্তরা সঠিক বিচার পাবেন না, এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
আর ভারত যদি মনে করে—সেই বিচার সুষ্ঠু হয়নি, তাহলে যে তাকে ফেরত দেওয়ারও প্রশ্ন উঠবে না, এ কথা বলাই বাহুল্য।
কেন আইসিটিবিডিতে বিচার হলে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, এটা জানতে দিল্লিতে বাংলা ট্রিবিউন কথা বলেছে আন্তর্জাতিক আইনের একাধিক বিশেষজ্ঞর সঙ্গে। এদের মধ্যে ভারতের দুজন সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলও আছেন, যারা নরেন্দ্র মোদি সরকারের শীর্ষস্থানীয় আইন কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এ বিষয়ে তাদের যুক্তিগুলো ঠিক কী, এই প্রতিবেদনে সেটাই সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
এই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইসিটিবিডিতে বিচারের মূল ভিত্তি হলো ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন– যার প্রধান লক্ষ্য ছিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধগুলোর বিচার। সেই সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ সংজ্ঞায়িত আইনের উদাহরণ ছিল মাত্র দুটি– ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের সনদ। ১৯৭৩ সালের আইনের খসড়া প্রণেতারা এই দুটি সংজ্ঞা গ্রহণ করেই মানবতাবিরোধী অপরাধের তালিকায় নির্যাতন, অপহরণ এরকম কয়েকটি অপরাধ যুক্ত করেছিলেন।
কিন্তু বিগত ৫০ বছরে মানবতাবিরোধী অপরাধের তালিকা অনেক বেশি সম্প্রসারিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সমর্থিত দুটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল– রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ায় গণহত্যার বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল যেসব রায় দিয়েছে, তারপর মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। এখন সেগুলোকে বিবেচনায় না নিয়ে আইসিটিবিডি যদি ১৯৭৩ সালের আইনের ভিত্তিতেই তদন্ত ও বিচার চালায়, তাহলে তা কিছুতেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্বীকৃতি পাবে না।