এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : পালটাপালটি শুল্কারোপের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ৯ এপ্রিল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম কমে দাঁড়ায় ৬০.৪৪ ডলার এবং ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম দাঁড়ায় ৫৭.১২ ডলার। অর্থাৎ, উভয় বেঞ্চমার্কের দামই কমে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর সর্বনিম্ন হয়েছে। এর পেছনে বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের চীনের ওপর শুল্ক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ১০৪ শতাংশ করা।
তবে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে এখনো কমছে না। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দাম কমানো হবে কিনা সেটা চলতি মাসের শেষ দিকে জানা যাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস/বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দেশে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিমাসে জ্বালানি তেলের মূল্য ঠিক করা হয়। এপ্রিলে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম অপরিবর্তিত ছিল। ৩০ এপ্রিলও একইভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে মে মাসের জন্য দাম কমানো হবে কিনা।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, দাম এখনকার মতো কম থাকলে আগামী মাসের সমন্বয়ে প্রভাব পড়বে। তবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ৪ বছর আগের দামে ফেরা সম্ভব হবে না। বিপিসির অস্বাভাবিক মুনাফা করার কোনো সুযোগ নেই; বরং তেলের দাম ভোক্তার জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করে বিপিসি।
জানা গেছে, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বুধবার আরও কমেছে। বুধবার ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম নেমে এসেছে ব্যারেল প্রতি ৬০ ডলারে। অর্থাৎ তেলের দাম এখন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর সর্বনিম্ন।
ট্রাম্পের ১০৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘটনায় চীনের অর্থনীতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ চীন। ফলে সোমবার বিশ্ববাজারে তেলের দাম ৪ শতাংশের বেশি কমেছে।
বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার পুরোটাই মেটানো হয় আমদানি থেকে। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে ভোক্তার ব্যয় বেড়ে যায়। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে বেশি চাহিদা ডিজেলের। কৃষি, শিল্প উৎপাদন ও পরিবহণ খাতে এ তেল ব্যবহৃত হয়। তাই এটির দাম বাড়লে পণ্যের দামও বেড়ে যায়, বাড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়। এখন বিশ্ববাজারে অব্যাহতভাবে তেলের দাম কমতে থাকায় এখন বেশি পরিমাণে তেল কেনা গেলে সরকারের মুনাফা হবে; মানুষও উপকৃত হবে। অর্থাৎ দেশের বাজারে তেলের দাম কমানো সম্ভব হবে।
গত কয়েক বছরে জ্বালানি তেলের দামে বড় রকমের উত্থান-পতন দেখেছে বিশ্ব। করোনা মহামারির প্রভাবে তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়। ২০২০ সালে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল) দাম ছিল গড়ে ৪২ মার্কিন ডলার। পরের বছর অস্থির হয়ে ওঠে তেলের বাজার। গড় দাম বেড়ে হয় প্রায় ৭১ ডলার।
তবে তেলের দামে বড় উল্লম্ফন ঘটে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। ওই বছর তেলের গড় দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, সর্বোচ্চ দাম ওঠে ১৩৯ ডলার। এতে বিশ্বজুড়ে জিনিসপত্রের দামও বাড়তে থাকে। দেখা দেয় চড়া মূল্যস্ফীতি। তবে পরের বছরই এটি কমে ৮০ ডলারে আসে। ২০২৪ সালেও দাম ৭০ ডলারের ঘরে ছিল। আর এখন এটি নেমে এসেছে ৬০ ডলারের কাছাকাছি।
দেশে ২০১৬ সাল থেকে টানা ৫ বছর ডিজেলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা। ২০২১ সালের নভেম্বরে দাম বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত এ দাম বহাল ছিল। একই সময়ে পেট্রোল ৮৬ ও অকটেন বিক্রি হয়েছে ৮৯ টাকায়। যুদ্ধ শুরুর পর দেশেও দাম বাড়ানো হয়। ২০২২ সালের আগস্টে একলাফে ডিজেলের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১১৪ টাকা। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ২৫ দিনের মাথায় দাম ৫ টাকা কমিয়ে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই সময় পেট্রোল ১২৫ ও অকটেন ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
তবে গত বছরের মার্চ থেকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ শুরু করেছে সরকার। সে হিসাবে প্রতিমাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হয়। গত দুই মাস ধরে দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ হিসাবে বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ১০৫ টাকায় আর পেট্রোল ১২২ ও অকটেন ১২৬ টাকায়।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, বিশ্ববাজারে দাম কমলেই সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাব পড়ার সুযোগ নেই। তেল কেনার পর দেশে আসতে এক মাস লেগে যায়। তাই স্বয়ংক্রিয় মূল্য প্রক্রিয়ায় আগের মাসের আমদানি খরচ ধরে মূল্য সমন্বয় করা হয়। তেলের দাম নির্ধারণে ডলারের দাম বড় সূচক হিসাবে কাজ করে।
বছরে ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি। এর মধ্যে ৪৬ লাখ টন ডিজেল। একমাত্র শোধনাগারটি থেকে পাওয়া যায় ছয় লাখ টন ডিজেল, বাকিটা আমদানি করতে হয়। ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম কমলে ডিজেলের দামও কমে যায়। গত এক সপ্তাহে ডিজেলের দামও কমেছে ৬ থেকে ৭ ডলার। এতে আমদানি খরচ কমবে বিপিসির।
বিপিসি ও ইআরএল (ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড) সূত্র বলছে, দেশে পরিশোধন করা হলে প্রতি লিটার ডিজেলে ১৫ টাকার বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব। দেশে প্রতিবছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে চাহিদা ৮০ লাখ টন ছাড়াতে পারে। আমদানি করা জ্বালানি তেলের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করতে হলে দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হবে। দ্বিগুণ সক্ষমতার নতুন শোধনাগারটি নির্মাণ করা গেলে মজুত সক্ষমতাও বাড়বে। কম দামের সময় বাড়তি আমদানি করে জ্বালানি তেল মজুত করতে পারবে বাংলাদেশ।
সুযোগ আছে দাম কমানোর : অকটেন ও পেট্রোল বিক্রি করে সব সময় মুনাফা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি। মূলত ডিজেলের ওপর বিপিসির লাভ-লোকসান নির্ভর করে। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। গত এক দশকে জ্বালানি তেল বিক্রি করে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। এর মধ্যে শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে তারা লোকসান করে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এরপর টানা দুই বছর গড়ে চার হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। এর বাইরে জ্বালানি তেল থেকে প্রতিবছর ১৩ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব নেয় সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের সূত্র যাচাই-বাছাই করার দাবি তোলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। নভেম্বরে তারা জানায়, বিগত সরকার বিপিসির বাড়তি মুনাফা ধরে দাম নির্ধারণের সূত্র ঠিক করেছে, যা ত্রুটিপূর্ণ। তেলের দাম বাজারভিত্তিক হলে লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা কমানো সম্ভব। এরপরও দাম নির্ধারণ হচ্ছে আগের সরকারের চূড়ান্ত করা সূত্র ধরেই। ফলে দাম তেমন একটা কমছে না।