বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৫:৩৫:২৬

মোদির মঞ্চ সাজাতে ব্যস্ত প্রবাসী বাঙালিরা

মোদির মঞ্চ সাজাতে ব্যস্ত প্রবাসী বাঙালিরা

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী : চায়ের কাপ শেষ করে সবে জুতোয় পা গলিয়েছেন যুধাজিৎ। ঠিক তখনই পিছন থেকে ভেসে এল প্রশ্নটা, ‘‘আজও?’’ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী হিসেবে সিলিকন ভ্যালিতে পা দেওয়া ইস্তক গত কয়েক বছরে কাজের দমছুট চাপ তার মতো অনাবাসী ভারতীয় বাঙালিদের গা-সওয়া।

অভ্যস্ত স্ত্রী, পরিবারও। কিন্তু গত এক মাস ধরে আরও বেশি ব্যস্ততা যেন তোলা থাকছে সপ্তাহান্তের ছু’টির দিন দু’টোর জন্য। গোটা সপ্তাহ অফিস করার পরেও প্রতি শনি-রবিতে দল বেঁধে ‘মঞ্চ বাঁধা’র কাজে যাচ্ছেন তারা। পুজার নয়, এই মঞ্চ তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রাণকেন্দ্র সিলিকন ভ্যালিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্ন ফেরির।

পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে বিজেপি সে ভাবে বড় শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি এখনও। জমি নীতি থেকে এসইজেড— প্রায় সব ক্ষেত্রেই গুজরাত মডেলের সঙ্গে বাংলার ততটাই মিল, যতটা কলকাতা আর ক্যালিফোর্নিয়ার। তা বলে মার্কিন মুলুকে বর্ণাঢ্য মোদি-বরণের প্রস্তুতিতে এক চুলও ফাঁক রাখছেন না সেখানকার অনাবাসী ভারতীয় বাঙালিরা। বরং বলা ভাল, অনেক ক্ষেত্রে নেতৃত্বই দিচ্ছেন তারা।

সেই জওহরলাল নেহরুর পরে এই প্রথম ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী পা রাখবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে। আসবেন সিলিকন ভ্যালিতে। সেই সিলিকন ভ্যালি, যা গুগ্‌ল, অ্যাপল, ফেসবুকের মতো এক ডাকে চেনা তথ্যপ্রযুক্তি বহুজাতিকের আঁতুড়ঘর। কলেজ ছেড়ে কোটি ডলারের সংস্থা বানিয়ে ফেলার গল্প যার অলিতে-গলিতে। যেখানে রাস্তায় বেরোলে বাঙালি সফ্‌টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দেখা হবেই। আর পুজোয় ক্যালিফোর্নিয়া এলে ঢুঁ মারা যাবে অন্তত পাঁচটি প্যান্ডেলে। ২৬ সেপ্টেম্বর মোদী এখানে আসবেন জানার পর থেকেই কোমর বেঁধে লেগে পড়েছেন এখানকার বাঙালিরা। যেন পুজোর আগেই কাঠি পড়েছে ঢাকে।

শিলিগুড়ির জয়দীপ দে। দুর্গাপুরের মৈনাক মিত্র। কসবার অনির্বাণ কুণ্ডু। বাগবাজারের শান্তনু কুণ্ডু। সল্টলেকের সৌরভ দত্ত। যাদবপুরের মানস রায়। গত এক মাস ঘুম ছুটেছে এঁদের সকলেরই। কখনও রাত জেগে ব্যানার তৈরির কাজ হচ্ছে, তো কখনও ভিড় সামলানোর মহড়া। কেউ কাজ করছেন ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে মোদী-সফরের প্রচারে। এখানে-ওখানে মিটিং, দফায়-দফায়। বারবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে। মিলিয়ে নেওয়া, কিছু বাকি থেকে গেল কি না।

গত এক মাস এদের অনেকেরই রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া হয়নি। মাথায় উঠেছে বেড়ানো। সব ফেলে এরা মশগুল মোদী-অভ্যর্থনায়। রেস্তোরাঁয় গিয়েও বা দু’দণ্ড নিশ্চিন্তি কই টালিগঞ্জের অবর্ণা সেনগুপ্ত, রাসবিহারীর সমাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, মধ্যমগ্রামের অস্মিতা মিত্র, বেহালার চন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, রুবি পার্কের শল্য কুণ্ডুর? সেখানেও গোলটেবিল বৈঠক। পরিকল্পনা, শাঁখ বাজিয়ে কুলো হাতে মোদী বরণের। পাক্কা বাঙালি মেজাজে। ঠিক হয়েছে, মেয়েরা যাবে লাল পাড় গরদের শাড়িতে। ছেলেরা ধুতি-পাঞ্জাবি কিংবা কুর্তা-পাজামা।

ঠিক হচ্ছে, কী হবে বাচ্চাদের পোশাক। ভারতীয়ত্বের ছোঁয়া সেখানে রাখা হবে কী করে। স্থানীয় পুজো কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে আনানো হচ্ছে ঢাক। তাঁদের বিশ্বাস, এমন আয়োজন মোদীর নজর কাড়বেই। সোম থেকে শুক্র এঁরা কেউ গুগ্‌ল, কেউ ইনফোসিস, ওরাক্‌ল, কেউ জিই-র কর্মী। কিন্তু উইকএন্ডে সকলেই ‘মোদী মিশন’-এ ব্যস্ত। বুঁদ মেনুতে ধোকলার সঙ্গে রসগোল্লাও পুরে দেওয়ার পরিকল্পনায়।

সংসদে রাজনীতির লড়াইয়ে তীরে এসেও তরী ভেড়েনি পণ্য-পরিষেবা করের। বিশ বাঁও জলে জমি-বিল। কিছুটা থমকে গিয়েছে সংস্কার। মোদীর ঘন ঘন বিদেশ যাত্রা নিয়ে কটাক্ষ করতেও ছাড়ছে না বিরোধী দলগুলি। কিন্তু সে সবের প্রায় পরোয়াই করছে না মার্কিন মুলুকের এই পশ্চিম প্রান্ত। ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অব বেঙ্গলের প্রেসিডেন্ট এবং নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনী যুধাজিৎ সেন মজুমদার বলছিলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছতে পারলে, বাংলা নিয়েও কথা বলব। অনুরোধ করব, সেখানে শিল্প আনতে কিছু করুন। তবে সেই সময় আদৌ পাওয়া যাবে কি না, তা বলা শক্ত।’’ সৌরভ বলছিলেন, ‘‘সুযোগ পেলে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব রাজ্যের মেধাসম্পদ কাজে লাগানোর জন্য।’’

মোদীর স্বপ্ন ফেরি দেশে বিরোধীদের যতই নিন্দে কুড়োক, আমেরিকায় ভারতীয়দের কাছে তিনি আবার সেই কারণেই ‘রকস্টার’। ইন্দো-আমেরিকান কমিউনিটি অব ওয়েস্ট কোস্টের চেয়ারম্যান চান্দ্রু ভাম্ব্রার কথায়, ‘‘এই বিপণনটাই তো কয়েক দশকে করে উঠতে পারেননি কেউ। অথচ যে কোনও দেশ বা সংস্থার কর্ণধারের সেটাই তো প্রধান কাজ।’’ ওই কমিটিরই ফান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান রমেশ জাপরার কথায়, ‘‘সকলেই জানতেন যে, এখানে কত ভারতীয়ের বাস। তবু শুধু সিলিকন ভ্যালিতে আসতেই কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কত বছর লেগে গেল!’’

২৬-২৭ সেপ্টেম্বরের সিলিকন ভ্যালি সফরে ফেসবুকের সদর দফতরে কর্ণধার মার্ক জুকেরবার্গের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন মোদী। আড্ডার মেজাজে কথা বলবেন আমন্ত্রিতদের সঙ্গে। যাবেন গুগ্‌লের সদর দফতরে। কথা বলবেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ এবং ভারতীয় ব‌ংশোদ্ভূত সিইও সুন্দর পিচাইয়ের সঙ্গে। মোদীর সঙ্গে দেখা হতে পারে অ্যাপল কর্ণধার টিম কুকের। সম্ভবত কথা হবে টেসলা-র শীর্ষ কর্তা এলন মাস্কের সঙ্গেও। ব্যাটারির গাড়ি তৈরিতে বিপ্লব এনে দেওয়া এই সংস্থা সম্ভবত রাস্তা দেখাবে ভারতে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর।

আর অবশ্যই সকলের চোখ থাকবে সান হোসের স্যাপ সেন্টারে। ২৭ সেপ্টেম্বর সেখানে বক্তৃতা দেবেন মোদী। অনাবাসী বাঙালি আয়োজকদের ওই দল জানাচ্ছে, ওই অনুষ্ঠানে থাকবেন মার্কিন কংগ্রেসের ৬০ প্রতিনিধি, সুন্দর পিচাই, মাইক্রোসফট সিইও সত্য নাদেল্লা, অ্যাডোবির শান্তনু নারায়ণ প্রমুখ। থাকবেন তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার আরও বহু দিক্‌পাল। আয়োজকদের দাবি, ‘‘স্যাপ সেন্টারে থাকতে আবেদন জমা পড়েছিল ৪৫ হাজারেরও বেশি। শিকে ছিঁড়েছে ১৮ হাজারের বরাতে।’’

মার্কিন মুলুকে কম্পিউটার-মাউস-ল্যাপটপ-কোডিংয়ে বছরভর বুঁদ থাকা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকের আশা, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র দৌড় শুরু হবে এখান থেকেই। তাদের কথায়, ‘‘কে বলতে পারে যে, ভারতে লগ্নি করবে না অ্যাপল?’’ আবার কেউ মনে করছেন, ফেসবুক, গুগ্‌ল, মাইক্রোসফটের মন্ত্র জপে এখান থেকেই ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র উড়ান শুরু করবে ভারত।

আসলে এই অধিকাংশ অনাবাসী বাঙালির কাছেই মোদী কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নন। বরং দেশের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি। যিনি উন্নত দুনিয়ার চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। জুকেরবার্গকেও বলেন ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর জন্য মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) বানিয়ে দেওয়ার কথা। সরকারের কথা টুইটার, ফেসবুকে জানাতে তিনি স্বচ্ছন্দ। আবার ৭ রেস কোর্স রোডের বাসিন্দা হওয়ার পরেও পিছপা নন চা-ওয়ালা হিসেবে নিজের দিন গুজরানের গল্প উজাড় করতে।

এই ভাবমূর্তির কতটা ‘মিথ’ আর কতটা বাস্তব, তা হিসেবের সময় জয়দীপদের নেই। মোদী শুধু বিপণন-গুরু নাকি সত্যি-স্বপ্নের ফেরারি, সময় নেই তার উত্তর খোঁজারও। সিলিকন ভ্যালিতে বাঙালি আয়োজকদের ঘরে শুধু স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি। -আনন্দবাজার

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে