আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অস্বাভাবিক রকমের তীব্র মৌসুমি বৃষ্টিতে নজিরবিহীন বিপর্যয় নেমে এসেছে ফিলিপাইনের জনজীবনে। অভিযোগ উঠেছে, দেশটির বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে, যা দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করেছে।
তীব্র বৃষ্টির পর রাস্তাগুলো যেন নদীতে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ চলাচল নিয়ে সংকটে পড়েছেন।
ছড়িয়ে পড়েছে লেপ্টোসপাইরোসিস নামে লিভারের রোগ। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করা ইঁদুরের মল থেকে এ রোগ ছড়ায়।
এসব অভিযোগ এখন পুরো ফিলিপাইনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মানুষ প্রশ্ন তুলছে - সরকার সড়ক, সেতু ও বাঁধ নির্মাণে বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো ব্যয় করলেও কেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?
টিকটক, ফেসবুক ও এক্স-এ ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
"ভূতুড়ে" প্রকল্পের জন্য চুক্তি হয়, যেগুলো বাস্তবে কখনোই আলোর মুখ দেখে না, এমন অভিযোগ তুলে সংসদ সদস্য ও নির্মাণ খাতের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা।
দেশটির প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ 'বংবং' মার্কোস জুনিয়র নিজেও এই সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে তিনি দেখেন, সেটি আদৌ নির্মিতই হয়নি।
পরবর্তীতে এক বক্তব্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মন্ত্রী জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থের ৭০ শতাংশই দুর্নীতির কারণে আত্মসাৎ হয়।
এই ঘটনায় সংসদের স্পিকার পদত্যাগ করেন, যদিও তিনি কোনো দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
এদিকে, সেনেটের নেতাকে পদচ্যুত করা হয়েছে। কারণ, তার ২০২২ সালের নির্বাচনি প্রচারে অনুদান দিয়েছিলেন, একটি সরকারি প্রকল্পের দরপত্রের কাজ পাওয়া একজন ঠিকাদার, যা আইনত নিষিদ্ধ।
আগামী ২১শে সেপ্টেম্বর, রোববার একটি দুর্নীতিবিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিক্ষুব্ধরা। ১৯৭২ সালের এই দিনে তৎকালীন নেতা ফার্দিনান্দ মার্কোস দেশে সামরিক আইন জারি করেছিলেন।
তার ছেলে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ 'বংবং' মার্কোস জুনিয়রের জানা থাকার কথা - জনরোষ কতটা ভয়ংকর হতে পারে।
১৯৮৬ সালে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনই তার বাবাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, যা দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়।
রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো আত্মসাতের অভিযোগ ছিল মি. মার্কোসের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখে আইনে সংস্কারের পথে হেঁটেছে ইন্দোনেশিয়া। গত সপ্তাহেই একই ধরনের আন্দোলন নেপালে সরকার পতনের কারণ হয়েছে।
তাই সোমবার, যখন ফিলিপাইনিরা জবাব চাইছিল, প্রেসিডেন্ট মার্কোস জুনিয়র ঘোষণা দেন একটি তদন্ত শুরু হবে, যা "প্রতারকদের মুখোশ খুলবে এবং তারা কত টাকা চুরি করেছে তা বের করবে"।
"আমি যদি প্রেসিডেন্ট না হতাম, তাহলে হয়তো আমিও তাদের সঙ্গে রাস্তায় থাকতাম," সাংবাদিকদের বলেন তিনি।
ফিলিপাইনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা এখন সরকারি অর্থ অপব্যবহারের অভিযোগ আছে এমন রাজনীতিবিদ ও ঠিকাদারদের সন্তানদের দিকেও ক্ষোভের তীর ছুঁড়ছেন। তাদেরকে 'নেপো বেবি' হ্যাশট্যাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, 'ডিজাইনার পোশাক' পরা ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করার চিত্র যারা তুলে ধরছেন তাদের নিয়েও ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করা হচ্ছে। তাদের অনেকে তরুণী।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তাদের ('নেপো বেবি') উচিত করদাতাদের ধন্যবাদ জানানো, কেননা তাদের কেনাকাটা ও ভ্রমণের খরচ সেই কর থেকেই এসেছে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি নেপালে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে একটি 'নেপো কিড' প্রচারণা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেশের আরও নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের পতন হয়।
ফিলিপাইনেও একজন সাবেক সংসদ সদস্যের মেয়েকে একবার পোশাকের জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তিনি ফেন্ডি ও ডিওর মিলিয়ে পরেছিলেন এবং বহুল কাঙ্ক্ষিত ও দামি হারমেসের বারকিন ব্যাগ বহন করছিলেন।
এই ধরনের তীর্যক মন্তব্যের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা অনেকেই তাদের অ্যাকাউন্টে মন্তব্যের সুযোগ বন্ধ বা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন।
অন্যদিকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া ক্ষোভ সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয় কিছু অ্যাকাউন্টের পেছনের মানুষদের একত্রিত করেছে।
ক্রিয়েটরস্ অ্যাগেইনস্ট করাপশন নামের একটি গ্রুপ বলেছে, "আমরা থামবো না। বরং আরও সোচ্চার হবো। আমরা ক্ষমতার সামনে আয়না ধরবো এবং ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত সরে দাঁড়াবো না।"
ফিলিপাইন জুড়ে এই ক্ষোভ শুধু অনলাইনে নয়, অফলাইনেও ছড়িয়ে পড়েছে। গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের জনসমক্ষে অপমান, অপদস্ত হওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে, এই বিভাগের প্রকৌশলীদের ইউনিফর্ম না পরার কথা বলা হয়েছে। সূত্র: বিবিসি