আন্তর্জাতিক ডেস্ক : নৌকো থেকে চরের বালিতে পা দিতেই সাবধানবাণী, ক্যামেরা ভিতরে রাখাই ভাল। কারণ, ছবি তুললেই চরের বাসিন্দারা ভেবে বসেন, ওই ছবিই দিসপুর থেকে দিল্লি পর্যন্ত ঘোষণা করে দেবে, চরবাসীরা সকলেই বাংলাদেশি।
প্রায় এক দশক আগে এই এলাকা থেকেই আতর ব্যবসায়ী বদরুদ্দিন আজমল সর্ব-বিপত্তারণের ভরসা দিয়ে রাজনৈতিক দল ইউডিএফের পত্তন করেন। গত ১০ বছরে রাজনীতি নয়, খানিক সাম্প্রদায়িক উস্কানি, বাকিটা মৌলানা হওয়ার সুবিধে আর ঝাড়ফুঁককে হাতিয়ার করে এআইইউডিএফ সুপ্রিমো এখানে ‘রাজ’ করছেন। কখনও তিনি বিধায়ক, কখনও তাঁর ছেলে। এখনও তিনিই সাংসদ। তবে উপ-মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার হাতছানিতে ছেলের স্থানে নিজেই লড়তে নেমে পড়েছেন আজমল। তবে দক্ষিণ শালমারা কেন্দ্রের বীরসিং চরে স্বাক্ষরতা যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে কমছে ‘হুজুর’-এর ‘ফুঁ দেওয়া জল’ পানের চাহিদা। চরবাসীদের আক্ষেপ, হুজুরের ঐশ্বরিক শক্তিতে আস্থা রেখেও চরে আসেনি বিদ্যুৎ, পানীয় জল। তাই প্রাক্তন বিধায়ক ও মন্ত্রী, কংগ্রেসের ওয়াজেদ আলি চৌধুরি এ বার কড়া টক্কর দেবেন আজমলকে।
চরের ভিতরে রাস্তা বলতে গ্রামের বাড়িগুলির ভিতর দিয়ে মাটির অলি-গলি পথ। কোনও মতে এগিয়ে চলা। স্থানীয় শিক্ষক সারজামাল হক, এফ এ শিকদাররা জানান, এলাকার ত্রিসীমানায় নেই বিনোদনের কোনও মাধ্যম। তাই গ্রামের মানুষের একমাত্র বিনোদন বলতে ‘স্মার্টফোন’। কিন্তু গ্রামের সৌর-প্যানেলের বিদ্যুতে একটি আলো-পাখার বাইরে অন্য কিছু চলে না। তাই প্রতিদিন চরের মানুষ ধুবুরি আসেন। ঘাটের পাশেই ১০ টাকার বিনিময়ে মোবাইল চার্জের দোকান। চার্জে বসিয়ে দিনের শেষে তা নিয়ে বাড়ি ফেরা। একই ‘মোবাইল’ রুটিন।
চরবাসী দয়ালচাঁদের আক্ষেপ, ফি বছর বন্যার জলে ঢুবে যাওয়া এই দ্বীপে পাকা বাড়ি বানিয়ে লাভ নেই। তাই টিনের ঘরই ভরসা। কিন্তু ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘর মেলে না, মেলে না ১০০ দিনের কাজও। তার মধ্যেই সরকারি খেয়ালে ধুবুরি জেলা কেটে মানকাচর-দক্ষিণ শালমারাকে পৃথক জেলা করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চরবাসীদের কথা ভাবা হয়নি। যেখানে আধ ঘণ্টা ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে ধুবরিতে সব কাজ করালে চলত, সেখানেই নতুন জেলার জেলা সদরে যেতে জলপথে তিন ঘণ্টা। স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত জেলা ভাগ হলেও বীরসিং চরের আদালত ও প্রশাসনিক কাজের দফতর ধুবুরিতেই রাখা হয়েছে।
কিন্তু দলের আঁতুড়ঘরে এআইইউডিএফের বিরুদ্ধে মানুষ কেন ফুঁসছে? বীরসিং বাজারের চায়ের দোকানে বসে সাহেব আলি, ডি আলি শেখ, আবু কালাম শেখরা বলছেন, ‘‘আমরা মৌলানাকে দেবতার মতোই মানতাম। তাঁর মুখের কথায় ভরসা ছিল। তিনি বলেছিলেন, সরকার লাগবে না, আমিই রাস্তা গড়ে দেব। সেতু গড়া হবে। কিন্তু হয়নি কিছুই। কলেজ নেই, বিকল জল-অ্যাম্বুলেন্স, ভাসমান হাসপাতালও খারাপ। জলে আর্সেনিক মিলেছে। সমস্যা বেড়েই চলেছে।”
অথচ এখনও মহিলারা হাতে জলের বোতল নিয়ে মৌলানা বদরুদ্দিন আজমলের ‘ফুঁ’ নেওয়ার জন্য লাইন দেন। ভাবা হয়, মৌলানার ফুঁ দেওয়া জল পান করলেই রোগমুক্তি হবে। বন্ধ্যার বাচ্চা হবে। প্রথম দিকে, ফুঁ দেওয়া জল খেয়ে এক মহিলার বাচ্চা হওয়ার পরে তার নাম রাখা হয় আজমল। কিন্তু দিন বদলাচ্ছে। বৃষ্টির পরেই চর ডুবে যায় জলে। তখন ঘরের দরজা পর্যন্ত নৌকোই ভরসা। বাকি সময় ঘাট থেকে গ্রাম পর্যন্ত ২০ টাকা করে নিয়ে লজঝড়ে গাড়িতে গ্রামবাসীদের আনা-নেওয়া করেন আমির আলি। তাঁর মতে, এত বছরেও শিক্ষা-স্বাস্থ্য-রাস্তা-বিদ্যুতের ব্যবস্থা না হওয়ায় দ্বীপের মানুষ বুঝতে পারছেন, যাদু দিয়ে জীবন চলছে না। চরে স্বাক্ষরতার আলো ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ঝাড়ফুঁকের উপরে বিশ্বাসও কমছে। আজমল বা তাঁর ছেলেরা ভোটের সময় ছাড়া কখনও চরে আসেন না। তাঁরা মুম্বই ও বিদেশেই সময় কাটান। তাই মানুষ এবার পরিবর্তন চাইছেন।
কিন্তু আজমল অনমনীয়। গৌরীপুর, বিলাসীপাড়া, কোকরাঝাড় চষে বেড়ানো মৌলানা এখনও নিজেকে সংখ্যালঘুদের ত্রাণকর্তা হিসেবেই ঘোষণা করছেন। নামনি অসমের সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় আজমলের ‘ক্রেজ’ যে কোনও সভায় চোখে পড়ে। গোঁসাইগাঁওয়ের তেলিপাড়ায় একটি জনসভায় এসেছিলেন জুরাইয়ের সামসুল আলম। তাঁর গ্রাম পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু মৌলানার আসার খবর পেয়েই তিনি ও তাঁর মতো অনেকে বাংলা থেকেও ছুটে এসেছেন অসমের জনসভায়। সামসুলের আশা, অসুস্থ মেয়ের জন্য হুজুরের আশীর্বাদ নিয়ে যাবেন।
গত বিধানসভায় ১৮ জন বিধায়ককে নিয়ে ‘প্রধান বিরোধী দল’-এর ‘মালিক’ নতুন বিধানসভায় সরকারের শরিক হবেন বলে ঘোষণাই করে দিয়েছেন। নামনির বাংলাভাষী মুসলিমরা তাঁর বড় ভরসার জায়গা। বড়োভূমিতে হওয়া সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরে সংখ্যালঘুরাও তাঁকে আঁকড়ে ধরেছেন। কিন্তু কংগ্রেস প্রশ্ন তুলছে, সংঘর্ষের নামে দেশ-বিদেশ থেকে তোলা টাকা কোথায় গেল? উত্তরের ধার ধারেন না আজমল। কারণ মানুষের আবেগ বা অন্ধবিশ্বাস যে রাজনীতির ধার ধারে না। তাই তামারহাটের কৃষক রফিক ইসলাম বলেন, “এত ঝড়বৃষ্টি মাথায় হুজুরের জন্যে অপেক্ষা করে আছি। কারণ আমাদের মঙ্গলের জন্যেই হুজুর যাদু করেন। আমরা প্রার্থীর নাম জানি না। হুজুরের জন্যেই ভোট দিই।”
বীরসিং, শালমারার অন্য একটি অংশ আবার বলছে, আজমলের সাম্প্রদায়িকতার জন্যেই আজ বেশি করে ভূমিপুত্র মুসলিমদের বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মাথা চাড়া দিচ্ছে বিজেপি। কংগ্রেসের সমর্থকরা এবার ফের হারানো জমি ফিরে পেতে মরীয়া। কিন্তু নির্বাচনের পরে তো তরুণ গগৈ সেই আজমলেরই হাত ধরতে চলেছেন? গরম হয়ে ওঠে বীরসিং চরের কংগ্রেসের নির্বাচনী দফতর। দিসপুরের যাই পরিকল্পনা থাক, স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীদের বিশ্বাস, আজমলকে জমি ছাড়তে হলে ওয়াজেদ আলির মতো কড়া প্রতিদ্বন্দ্বীকে ফের লড়াইয়ে নামাতেন না গগৈ।
এক দিকে হুজুরের বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে জনমত। অন্য দিকে, নামনিতে চার বিধায়কও টিকিট না পেয়ে এআইইউডিএফের বিরুদ্ধে লড়ছেন। বর্তমানে এআইউউডিএফের বিধায়ক থাকা গুল আখতারা বেগম টিকিট না পেয়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে নাগাড়ে আজমলের নিন্দে করে চলেছেন। জনসভায় বলছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে সর্বানন্দ সোনোয়াল ও হিমন্তবিশ্ব শর্মার মতো পুরনো আসু নেতারা এনআরসির ভিত্তি বছর ১৯৫১ সাল করে দেবে। কংগ্রেসের হয়ে প্রচারে ধুবুরিতে ঘোরা গুলাম নবি আজাদ বলে গেছেন, “গুল আখতারা তো ধুবুরির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!”
এত প্রতিকূলতায় আজমলের হিসেব মিলবে তো? আজমল বলেন, “মানুষ আমার উপরে ভরসা করে ভোট দেন। যাঁরা দলের বিরুদ্ধে গিয়েছেন তাঁরা অন্যায় করছেন। দলে এর প্রভাব পড়বে না। বরং ওদের রাজনৈতিক জীবনই শেষ হবে।” উড়ে যায় হুজুরের হেলিকপ্টার। তখনও ধানক্ষেত দিয়ে দৌড়ে আসছে বাচ্চা-কাচ্চা, পুরুষ-মহিলা। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
০৮ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএস