আন্তর্জাতিক ডেস্ক : তোমার জায়গায় কেন আমি হলাম না। তোমার বদলে বোমাটা কেন আমার গায়ে পড়লো না। ভাইয়ের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই কথাগুলো বলছিল সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের ছোট্ট এক বালক। হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা সিরিয়ায় সরকার ও বিরোধীদের বোমা হামলায় নিহত হয়েছে তার বড় ভাই।
আলেপ্পোর আল শুকুর জেলার বাসিন্দা ওই বালক ব্যাগে মোড়ানো ভাইয়ের লাশটি দেখে বারবার বলছিল ‘আমার বাবার ভালোবাসা তুমি’। উদ্ধারকারীরা তার ভাইয়ের মৃতদেহটি সরিয়ে নেয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই চিৎকার করতে থাকে ওই বালক। তবে এ কান্না শুধু একজন সিরীয় বালকেরই নয়, এ কান্না সব সিরীয়বাসীর। কান্নাই যেন তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে চলা যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছে উভয়পক্ষ। গত বুধবার আলেপ্পোর একটি হাসপাতাল ও পার্শ্ববর্তী একটি আবাসিক ভবনে সরকারি বাহিনী হামলা চালিয়েছে। এতে শিশুসহ কমপক্ষে ৫৫ জনের বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।
বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে আলেপ্পোতে। আসাদ বাহিনী ও তার মিত্ররা বিরোধীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে চালিয়ে যাচ্ছে হামলা। বসে নেই বিরোধীরাও। তারাও দিচ্ছে পাল্টা জবাব। আর দুই পক্ষের ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সাধারণ মানুষ। হামলা হচ্ছে হাসপাতাল লক্ষ্য করে। চিকিৎসা সেবা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না তারাও। বুধবারের পর শুক্রবার আবারো চালানো হয়েছে হামলা। যুদ্ধ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না সিরিয়ায়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউমেন’ জানায়, বুধবার আলেপ্পো শহরের আল কুদস হাসপাতাল ও পার্শ্ববর্তী একটি আবাসিক ভবনকে লক্ষ্য করে চালানো বিমান হামলায় নিজতদের মধ্যে একজন চিকিৎসক ও হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারীও রয়েছেন। তিনি ছিলেন ওই এলাকায় একমাত্র শিশু চিকিৎসক।
আলেপ্পো শহরে গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ছয় দিনের সরকারি বাহিনীর বিমান হামলায় শতাধিক বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিদ্রোহী বাহিনীর শেল নিক্ষেপে নিহত হয়েছে আরো ৪৯ বেসামরিক নাগরিক। সিরিয়ায় এমন এক সময়ে এসব ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটছে যখন যুদ্ধবিরতি কার্যকরে তৎপর রয়েছে জাতিসংঘ।
এর আগে শনিবার জাতিসংঘ দূত স্টাফান ডি মিসতুরা জানান, এতোদিন ধরে সিরিয়া যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা আড়াই লাখ বলে জানা গেলেও এর প্রকৃত সংখ্যা হবে চার লাখেরও বেশি। বর্তমানে সিরিয়ার সংঘাতে নিহতের আর কোনো হিসাব রাখছে না জাতিসংঘ। কারণ সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যকার যুদ্ধ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটির অনেক এলাকায়ই প্রবেশ করতে পারছে সংস্থাটির প্রতিনিধি দল।
আরব বসন্ত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১১ সালের ১৫ মার্চ সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দেরায় গণতন্ত্রপন্থীরা শুরু করে শান্তিপূর্ণ একটি বিক্ষোভ। এরই এক পর্যায়ে নিজেদের রক্ষার জন্য বিরোধীরা হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর একটি দল সরকারের বিরুদ্ধে গঠন করে বিদ্রোহী ব্রিগেড। ছড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধ।
যুদ্ধে ইরান, রাশিয়া, সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো আঞ্চলিক এবং বিশ্বশক্তিগুলোর অংশগ্রহণ একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আসাদ কিংবা বিদ্রোহীদের পক্ষে তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন যুদ্ধকে আরো তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে। প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় সিরিয়া।
বিদেশি শক্তিগুলো দীর্ঘস্থায়ী করেছে সিরিয়ার সঙ্কট। একদিকে বাশার বাহিনী, বিদ্রোহী গোষ্ঠি এবং কুর্দিদের মধ্যে চলতে থাকে যুদ্ধ। অপরদিকে চলতে থাকে রাশিয়ার আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিমান হামলা। আসাদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয় রাশিয়া আর ইরান। অপরদিকে ‘মডারেট’ বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুদ্ধে নিগ্রহের শেষ নেই সিরিয়াবাসীর। ৭০ ভাগ মানুষই পায় না বিশুদ্ধ পানি। ৬০ লাখ শিশুসহ দেশটিতে বর্তমানে অবস্থানরত ১৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে মানবিক সহায়তা দিতে ২০১৬ সালেই দরকার ৩.২ বিলিয়ন ডলার। দেশটির প্রতি তিনজন মানুষের একজন পায় না পর্যাপ্ত খাবার।
২০ লাখেরও বেশি শিশু বঞ্চিত শিক্ষার অধিকার থেকে। আর দারিদ্য সীমার নিচে বাস করে পাঁচ জনে চারজন। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে কোনো পক্ষই রাজি হচ্ছে না পরাজয় মেনে নিতে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বারবার আহ্বান সত্ত্বেও সাড়া দিচ্ছে না কেউ।-বাংলামেইল
২৯ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই