আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতে কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানাধিকারীদের একজন, আনসার শেখ জানিয়েছে যে ওই পরীক্ষার প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় পুনে শহরে তাকে একটি হিন্দু নাম নিয়ে থাকতে হয়েছিল – নইলে তাকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছিল না।
পরীক্ষায় প্রথমবারের চেষ্টাতেই সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পর – অচিরেই সে দেশের কোনো জেলায় কালেক্টর বা জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাবে বলে আশা করছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ খবর জানা যায়।
গত দুবছর ধরে শুভম নামে এক হিন্দু বন্ধুর নাম ধার করে কাটানোর পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আনসার এখন আবার তার পুরনো নামে ফিরে গেছে – কিন্তু তার এই অভিজ্ঞতা ভারতীয় সমাজে মুসলিমদের অবস্থা নিয়ে নতুন করে নানা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলেছে।
ভারতে সাবেক মুসলিম আমলারাও কেউ কেউ বলছেন, পরীক্ষাতে না-হলেও ধর্মের কারণে চাকরিজীবনে তাদের বৈষম্যের মুখে পড়তে হয়েছে।
বাইশ বছর বয়সী আনসার শেখ ভারতের মহারাষ্ট্রের জালনা জেলার এক অটোরিক্সা চালকের ছেলে।
গরিব পরিবারের মেধাবী যুবকটি দেশের সর্বোচ্চ আমলা বা আইএএস হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল কাছের বড় শহর পুনেতে – সেখানে থেকে পরীক্ষার প্রশিক্ষণ নেবে বলে।
কিন্তু মুসলিম নাম শুনেই তাকে ফিরিয়ে দেন একের পর এক বাড়িওলা – বাধ্য হয়ে তাকে তখন এক হিন্দু বন্ধুর নাম ভাঁড়িয়ে পুনে শহরে মাথার ওপর ছাদ জোটাতে হয়।
আনসার বলছিল, ‘শুধু আমার মুসলিম পরিচয়ের কারণে তারা সটান আমার মুখের ওপর বলে দেয় আমাকে থাকতে দিতে পারবে না। তবে আমি নিশ্চিত, শুধু মুসলিম নয় – একলা একজন মহিলা বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরও ভারতে একই অভিজ্ঞতা হবে।’
‘তবে এই প্রত্যাখ্যানে আমি ভেঙে পড়িনি, নাম ভাঁড়িয়েই থাকার ব্যবস্থা করে নিই – এবং এই ঘটনাটা কিন্তু দেশের পরিস্থিতি পাল্টানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেই আমাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে।’
আনসার শেখ এ কথা বলছে, ভারতের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথমবারের চেষ্টাতেই সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পর – অচিরেই সে দেশের কোনও জেলায় কালেক্টর বা জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাবে।
জালনা জেলায় তার গ্রামের বাড়িতে যথারীতি খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে – কিন্তু তার দরিদ্র বাবা শেখ ইউনুস ভুলতে পারেন না কত কষ্ট করে ছেলেকে পড়িয়েছেন।
তিনি বলছিলেন, ‘ও ক্লাস টেনে পড়তেই আমাদের ভিটেমাটি বেচে ওকে পড়িয়েছি – তারপর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, ওর আম্মির রোজগারের পয়সা তিল তিল করে জমিয়ে ওকে প্রতি মাসে পড়াশুনোর জন্য পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা করে পাঠাতাম। অনেক কষ্ট করে পড়ানো – আজ ভীষণ খুশি আমি, মনে হচ্ছে যেন আমরা নতুন জীবন পেয়েছি।’
এই পরিবারটির এত কঠিন লড়াইয়ের একটা বড় কারণ তারা ভারতীয় সমাজে ধর্মীয় সংখ্যালঘু – অন্তত পুনেতে আনসার শেখের অভিজ্ঞতা তেমনই আভাস দেয়।
ভারতের একজন সাবেক আইএএস অফিসার ও পশ্চিমবঙ্গে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক প্রধান সৈয়দ নুরুল হক বলছিলেন – প্রবেশিকা পরীক্ষায় না-হোক, চাকরিজীবনে কিন্তু মুসলিম আমলাদের ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হওয়াটা বিরল নয়।
মি. হকের কথায়, ‘মুসলিম বলে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বা অন্য কোনো পরীক্ষায় নম্বর পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু চাকরিজীবনে দেখলাম যখনই কোনো ভাল পোস্টিংয়ের প্রশ্ন এল, তখনই কিন্তু মুসলিম প্রার্থী বলে খারাপ পোস্টিং পেলাম।’
‘কিংবা ধরুন এমনো হয়েছে, কোনো একটা পরিস্থিতি সামলানো নিয়ে কথা বলছি – আমার অধীনস্থ অফিসার আমার সামনেই বলে বসলেন ‘ওরা মুসলিম, আমরা যা বলব তাই শুনবে – সংখ্যালঘু না?’ তাহলেই বুঝুন, সাম্প্রদায়িকতা আসলে এই সমাজের রক্তের ভেতরেই আছে’, আরো বলছিলেন তিনি।
ফলে শুভম নাম থেকে আনসার শেইখ এখন আবার তার পুরনো পরিচয়ে ফিরে গেছে ঠিকই – কিন্তু সামনে পড়ে থাকা চাকরিজীবনে এই নামের জন্য তার আর কোনো ভোগান্তি হবে না এটা কিন্তু এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
১৫ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই