আন্তর্জাতিক ডেস্ক : শনিবারই কলকাতায় ফিরলেন ওরা তিনজন৷ একজন কফিনবন্দি রাজীব ভট্টাচার্য৷ একজন মৃত্যুর চৌকাঠ দেখে এসেছেন৷ তবে এখনো যুঝে চলেছেন শরীরের ক্ষতগুলোর সঙ্গে৷
তিনি সুনীতা হাজরা৷ আর একজন সফল সামিট সেরে ফিরেও মুষড়ে রয়েছেন তিন সহ-অভিযাত্রীকে হারানোর শোকে৷ তিনি দেবরাজ দত্ত৷ তিন সন্তানের জন্যই আজ কাঁদল শহর৷
হাজার মানুষের চোখের জলে শেষ বিদায় নিলেন এভারেস্ট জয়ী পর্বতারোহী বরাহনগরের ঘরের ছেলে রাজীব ভট্টাচার্য৷ শনিবার বিকেলের বিমানে কাঠমান্ডু থেকে রাজীবের দেহ এসে পৌঁছায় বরাহনগরের মাতৃমন্দির পূজা কমিটির মাঠে৷
১৯ মে নেপালের ধৌলাগিরি শৃঙ্গ জয়ের পরে নামার পথে আচমকাই দুর্যোগের মধ্যে পড়েন রাজীব৷ তার চোখের সান প্রোটেক্টরটি হারিয়ে যায় তুষারঝড়ের মুখে৷ স্নো-ব্লাইন্ডনেসের পাশাপাশি হাতে পায়ে ফ্রস্ট-বাইটও কাবু করে ফেলেছিল তাকে৷
শারীরিক দুর্বলতার কারণেও তার পক্ষে আর নেমে আসা সম্ভব হয়নি৷ সঙ্গী শেরপা তাকে সেখানেই মৃত্যুর মুখে ছেড়ে নেমে আসেন৷ পরদিন সকালে এক দিকে শৃঙ্গ জয়ের সংবাদ, আর তার পরেই দুঃসংবাদ এসে পৌঁছায় বরাহনগরের বাড়িতে৷ আচমকাই টিভির পর্দায় রাজীবের দুঃসংবাদ দেখে হতভাগা মা সাধনা ভট্টাচার্য ভেঙে পড়েন৷
সেদিনই রাজ্য সরকারের উদ্যোগে উদ্ধারকারী দল তৈরি করা হয়৷ পর দিনই রাজীবের এভারেস্ট জয়ের সঙ্গী দীপঙ্কর ঘোষের নেতৃত্বে উদ্ধারকারী দল রওনা দেয় কাঠমান্ডুর উদ্দেশে৷
সেই থেকেই চলছিল দেহ উদ্ধারের লড়াই৷ কখনও খারাপ আবহাওয়া, তো কখনও হেলিকপ্টার না পাওয়া- এসব সমস্যার জেরে প্রথম এক সন্তাহ দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি৷
শেষমেশ ২৭ মে প্রায় ৭,৮০০ মিটার উঁচু থেকে তার দেহ নামানো হয় বেস ক্যাম্পে৷ সেখান থেকেই আসা হয় কাঠমান্ডু৷ শনিবার রাজীবের দেহ এসে পৌঁছাল বাড়িতে৷
মাতৃমন্দির পুজো কমিটির মাঠে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে তাকে র্গাড অফ অনার দেয়ার আয়োজন করা হয়৷ হাজরি ছিলেন পুলিশ কমিশনার নীরজ সিং এবং অন্য আধিকারিকরা৷
দেহ পৌঁছানোর আগেই হাজির হন বিধায়ক তাপস রায়৷ বরানগরের কাউন্সিলরেরাও৷ আসেন উত্তর দমদমের সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য৷
ঠিক সাড়ে সাতটায় রাজীবের দেহ নিয়ে মাঠে আসেন রাজ্যের দুই ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও লক্ষ্মীরতন শুক্লা৷ এর পরেই পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শুরু হয় রাজীবকে গার্ড অফ অনার দিয়ে শেষ বিদায় জানানোর পালা৷
তার পরে একে একে পুষ্পস্তবক দেন মন্ত্রী, বিধায়ক ও কাউন্সিলররা৷ পুষ্পস্তবক দেন কমিশনার ও অন্য পুলিশ আধিকারিকরাও৷ রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী রাজীবের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন৷
রাজীবের দুঃসংবাদ আসার পর থেকেই বৃদ্ধা সাধনা বারবার খুঁজছিলেন আদরের বাপিকে (রাজীবের ডাক নাম)৷ সেই বাপি এল নয়দিন পর৷
জনতার কাঁধে কাঁধে, কফিনবন্দি হয়ে৷ দু'হাতে ছেলের মুখটা তুলে ধরে ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধা৷ রাজীবের জ্যাঠতুতো দিদি পম্পা চক্রবর্তী জানালেন, 'ও আমাদের সবার ছোট ছিল৷ পাহাড়ই ছিল ওর জীবনের সব কিছু৷
ওর মা আজ সারা দিন মুখে কিছুু দেননি৷ ছেলেকে দেখবেন বলে উপোস করে রয়েছেন৷ রাজীবকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছিলেন দু'বছর আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা জয়ে তার সঙ্গী এবং তার পরে ইয়েলুংথামের পথে হারিয়ে যাওয়া ছন্দা গায়েনের দাদা জ্যোতির্ময়৷
তিনি বললেন, 'ছন্দার মতোই রাজীবের মৃত্যুও যেন রহস্যে ঢাকা৷ সেই একই ২০ মে, আর একই শেরপা৷ জানি না এর কী রহস্য৷
শনিবার রাতে বরাহনগরের রতনবাবুর ঘাটে রাজীবের শেষকৃত্য হয়৷ শনিবার বাড়ি ফিরেও কেঁদেই চলেছেন সুনীতা হাজরা৷
এভারেস্ট-জয়ীর কথায়, 'সাফল্যের চেয়ে সঙ্গীদের হারানোর যন্ত্রণা অনেক বেশি৷' দু'গালে এভারেস্টের ক্ষতচিহ্ন এখনও তাজা৷ দু'হাতেও তাই৷ চোখে-মুখে ক্লান্তি এখনও স্পষ্ট৷
নিজে ঘরে ফিরলেন প্রায় দু'মাস পরে৷ দিন দশেক আগে অনিশ্চিত ছিল সেটাও৷ তুষার ঝড়ে হারিয়েছেন তিন সঙ্গীকে৷ দু'জন মৃত৷ একজন এখনও নিরুদ্দেশ৷ নিজেও হারিয়ে গিয়েছিলেন প্রায় দু'দিন৷
চার নম্বর বেস ক্যাম্প থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে৷ ফুরিয়ে আসছিল অক্সিজেন৷ সঙ্গী শেরপাকে বলেছিলেন, এগিয়ে যেতে৷ চলার ক্ষমতাও যেন আর ছিল না৷
ওই নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বারবার ভেসে উঠছিল ছোট্ট ছেলেটার কথা৷ আর সেটা ভেবেই চালু রেখেছিলেন নিঃশ্বাস৷ তখনই দেবদূতের মতো হাজির হয়েছিলনে এক ইংরেজ অভিযাত্রী৷
তার লেসলি নামটুকুই খালি মনে রয়েছে সুনীতার৷ লেসলি তাঁর অক্সিজেন খুলে দিয়েছিলেন সুনীতাকে৷ আশ্রয় দিয়েছিল তার তাঁবুতেও৷
নিজের সামিট বাতিল করে সারা রাত সুনীতার সেবাও করেছিলেন ওই বিদেশি৷ সেই কথা বলতে গিয়ে এখনও কৃতজ্ঞতায় চোখে জল ঝরে পড়ে সুনীতার৷ পরেও লেসলির স্ত্রী হাসপাতালে ফোন করে তার খোঁজ নিয়েছেন৷
শেষ পর্যন্ত শনিবার সন্ধ্যায় বারাসতে নিজের বাড়িতে ফিরলেন সুনীতা৷ পাড়া-প্রতিবেশীরা সবাই একবার দেখা করতে চাইছেন এভারেস্ট বিজয়িনীকে৷
এসেছিলেন বারাসত পুরসভার চেয়ারম্যান সুনীল মুখোপাধ্যায়৷ তার কথায়, 'সুনীতার লড়াই শিক্ষণীয়৷' সুনীতা অবশ্য এভারেস্ট জয় নিয়ে কোনও কথা বলতে চান না৷ কাঁদতে কাঁদতে একটাই কথা বললেন, 'আমরা একটা টিমে ছিলাম৷ এভাবে সঙ্গীদের হারালে সাফল্য বলে আর কিছু হয় না৷'
শনিবার দেবরাজের জন্যও শহর ভাসল আনন্দাশ্রীতে৷ এভারেস্টের শিখর ছুঁয়ে ফেরা ছেলেকে অভিবাদন জানাতে হাওড়া স্টেশনে ভিড় জমতে শুরু করে সকাল থেকেই৷
বেলা ২টার দিকে ১১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে শতাব্দী এক্সপ্রেস থেকে নামেন দেবরাজ৷ তার ক্লাবের তরফেও সংবর্ধনা দেয়া হয় এই পর্বতারোহীকে৷
তার কথায়, 'পাহাড়ে প্রতিকূল পরিবেশে ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই আসল কাজ৷ সেটা না পারলেই দুর্ঘটনায় পড়তে হয়৷ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি বলেই বেঁচে গিয়েছি৷'
কিন্ত্ত যাদের সঙ্গে রওনা দিয়েছিলেন তাদের অনেককেই ছেড়ে আসতে হয়েছে সাফল্যকে ছুঁয়ে নেমে আসার পথেই৷ সে কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না দেবরাজ৷ তার হাসিতেও যেন দেখা গেল লেগে রয়েছে সেই বিষাদেরই ছায়া৷ সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া
২৯ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম