আন্তর্জাতিক ডেস্ক :ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে গণভোটে ব্রিটেনের বিদায় ততক্ষণে গোটা দুনিয়া জেনে গিয়েছে। ব্রিটিশ জনতার একাংশ আনন্দ করছেন, অনেকে আবার হতাশ। একই অবস্থা সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দেরও। তাঁদের অনেকেই আবার বাঙালি। কেউ দেড় দশক তো কেউ সাড়ে তিন দশক কাটিয়ে ফেলেছেন রানির দেশে। কেউ নাগরিক, কেউ নেহাতই কাজের সূত্রে দীর্ঘ দিন ধরে আছেন। ব্রেক্সিট-উত্তেজনার আঁচ পোয়াচ্ছেন সকলেই। ফল বেরোনোর পরে সকলেই বিভ্রান্ত! আগামী দিনে কী হবে, নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউই।
ব্রিটিশদের একটা বড় অংশের মতোই সেখানকার ভারতীয়দের অনেকে মনে করছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তে অর্থনৈতিক ভাবে আখেরে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে ব্রিটেনের। কেন? তাঁদের মতে, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে গত দু’বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ অভিবাসী কাজের খোঁজে ব্রিটেনে এসেছেন। ইইউ-এর নিয়মে এটা করা যেতেই পারে। সদস্য দেশ হিসেবে এটা আটকানো যায় না। ফলে এই বিপুল সংখ্যক বেকারের বোঝা চেপেছে ব্রিটেনের অর্থনীতির ঘাড়ে। ইইউ থেকে বেরিয়ে এলে এই চাপ এক ধাক্কায় অনেকটাই কমবে।
আবার অনেকে বলছেন, এ ভাবে বেরিয়ে আসায় আর্থিক ক্ষতি হবে ব্রিটেনেরই। কেউ বলছেন, এর ফলে আগামী কয়েক দিনে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। সেই আশঙ্কা উড়িয়ে অনেকে আবার বলছেন, মোটেই তা হবে না। দাম বাড়লেও তা হবে ক্ষণস্থায়ী। কারণ, ইইউ-সঙ্গ পুরোপুরি ছাড়তে অন্তত দু’বছর সময় লাগবে। তত দিনে মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা সামাল দেওয়া যাবে।
তবে সব পক্ষেরই চিন্তা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে। এক কথায় সকলেই মেনে নিচ্ছেন, এ বারে যুদ্ধটা ব্রিটেনের পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে গেল। ইরাক-সিরিয়া-তুরস্ক-লেবাননের সীমা ছাড়িয়ে জঙ্গি সন্ত্রাস যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাবা বসাচ্ছে, তখন ইইউ-ভুক্ত দেশগুলো এত দিন পর্যন্ত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ব্রেক্সিটের ফলে সেই লড়াই অনেকটাই ধাক্কা খাবে আর ব্রিটেনই আখেরে সবচেয়ে বেশি ভুগবে। জঙ্গিদের সম্ভাব্য গতিবিধি সম্পর্কিত যে সব তথ্য ইইউ-ভুক্ত দেশগুলি এত দিন নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান করত, সেই সব তথ্য ব্রিটেন আর এত সহজে পারে না।
দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটেনের নাগরিক, চিকিৎসক শুভজিৎ দত্তরায় বলছেন রাতারাতি কিছু বদলাবে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ আগে যেমন ভিসা ছাড়া ইউরোপের অন্য দেশে যাতায়াত করতে পারতেন, এখনও তেমনই পারবেন। জার্মানি, ফ্রান্স থেকে যে হারে গাড়ি ও সুগন্ধি আসত, তা-ও আসবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরোনর সময়ে ব্রিটেন কী চুক্তি করছে, পুরোটাই নির্ভর করবে তার উপরে। তবে সামনের দিনে প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা এই বাঙালি চিকিৎসকের।
আক এক বাঙালি রাজশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় দেড় দশক ধরে আছেন ব্রিটেনে। তাঁর কথায়, ‘‘এমন গণভোট বা নির্বাচনী প্রচার এর আগে দেখিনি, যখন জনগণের মতামত এত বিভক্ত। আর তা হয়েছে যুক্তির নিরিখে নয় বরং তিক্ততার কারণে।’’ তাঁর মতে এই গণভোটের ফলাফলে সারা দেশে অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দেশের সব কিছুর উপরেই এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন রাজশেখর। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা সজোরে ব্রেক্সিটের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছিলেন তাঁরাও অনেক সতর্ক। সব মিলিয়ে কেমন একটা দম বন্ধ করা অবস্থা।’’
তবে সকলেই একটি বিষয় নিয়ে সরব। সেটা ইইউ-এর ‘দাদাগিরি’। ৭২ বছরের বৃদ্ধা ব্রিটিশ নাগরিক জয়া মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমাদের দেশে বাজারে যে কলা, যে শসা বিক্রি হয়, তার আকার কী হবে, তাও ঠিক করে দেয় ইইউ! একটি খালি বয়ামে জ্যাম রাখার পরে সেই জারটিকে দ্বিতীয় বার ব্যবহার করা যাবে না। করলে ইইউ-এর নিয়মে তা বেআইনি হবে! ব্রাসেলসে বসে সেখানকার আমলাদের এই চোখরাঙানি অনেক সহ্য করেছি আমরা। আর নয়।’’ বৃদ্ধার মন্তব্য, ‘‘আমার ছেলে সুনীল স্থপতি। সে এখানে কোনও বাড়ি বানালে তাকে ব্রাসেলসের নিয়ম মেনে বাড়ি বানাতে হয়!
এটা কেন হবে? তা-ই যা হয়েছে, ভালই হয়েছে।’’
ব্রিটিশদের অনেকে আবার যুক্তি দিচ্ছেন, ব্রেক্সিটের ফলে আখেরে লাভ হবে ভারত-ব্রিটেন বাণিজ্যিক সম্পর্কের। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ডেভিড ব্রেনন-এর কথায়, ‘‘ইইউ-এ থাকার ফলে যে সব শর্ত মেনে চলতে হতো, এখন আর তা মানতে হবে না। এতে ভারত ও চিনের মতো বড় দেশের সঙ্গে ব্রিটেনের বাণিজ্য অনেক সহজ-সরল হবে। আগে এদের সঙ্গে যত বাণিজ্য করতে পারতাম, এ বার তার থেকে অনেক বেশি পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারব আমরা।’’
২৬জুন২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এআর